ad720-90

করোনার দুঃসময়েও কয়েকটি আশার কথা


সারা বিশ্বে যেভাবে করোনার প্রকোপ এখনো বাড়ছে, তাতে এটা পরিষ্কার যে সামনের সময় এখনো কঠিন। প্রায় সব দেশেই কমবেশি লকডাউন চলছে। ইউরোপ-আমেরিকায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার স্থিতাবস্থা বা কমের দিকে হলেও এখনো বিপদ কাটেনি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই রোগ ঠেকাতে আরও কয়েক মাস সময় লাগবে। তারপরও সেটা হয়তো কয়েক মাস পরপর ঘুরেফিরে হানা দেবে। তাহলে বিশ্বের সব মানুষই তো এক অবিরাম ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। আমাদের প্রিয় পৃথিবী কি এক অভিশপ্ত গ্রহে পরিণত হবে?

অবশ্য এই দুঃসহ অবস্থার মধ্যেও কিছু সুসংবাদ আছে। যেমন, সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের ওষুধ ও টিকা আবিষ্কারের জন্য দিনরাত গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছেন। প্রথমে ধরুন ওষুধের কথা। মানে, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ করে তোলার কোনো ওষুধ। এখন পর্যন্ত এ রকম নিশ্চিত কিছু নেই। বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা বলছেন অবশ্য কিছু ওষুধের কথা। কিন্তু ওই সব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে এখনো আরও পরীক্ষা দরকার।

এরই মধ্যে একটি সুখবর এসেছে আমেরিকার শিকাগো থেকে। করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় শিকাগো হাসপাতালে রেমডেসিভির নামে একটি অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ সুফল দিচ্ছে। সুখবরটি দিয়েছে মার্কিন প্রতিষ্ঠান গিলিয়াড সায়েন্সেস। তাদের ওষুধে যদিও সুফল পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু এখনো সেটা পরীক্ষা পর্যায়েই রয়েছে। কারণ যথেষ্টভাবে পরীক্ষিত হয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ঘোষণা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত ফল পেতে এখনো কিছু সময় দরকার। ওরা অবশ্য আশাবাদী যে সাফল্য দোরগোড়ায়।

এই আশা সত্য হলে, বলতে হয় অন্তত করোনায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের একটি পরীক্ষিত ওষুধ আমরা পেয়ে যাব। অন্তত এই আশা থাকবে যে বিনা চিকিৎসায় কাউকে মরতে হবে না। এখন তো ভেন্টিলেশন আর কৃত্রিম উপায়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের ওপর নির্ভর করাই একমাত্র চিকিৎসা। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ওষুধ আবিষ্কার হলেই পরিস্থিতি বদলে যাবে।

শুধু শিকাগোতেই নয়, একই সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দাবি করছে যে ওরা ওষুধ আবিষ্কারের খুব কাছাকাছি। হয়তো শিগগিরই বাজারে আমরা ওষুধ পাব।

কিন্তু শুধু ওষুধেই কাজ হবে না। কারণ, এই রোগটা কিছুদিন পরপর ঘুরেফিরে আসবেই। তাই টিকা দরকার। এবং এখানেও একটা বড় সুখবর আছে। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাঁদের আবিষ্কৃত একটি টিকা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তৈরি হয়ে যাবে। এটা অবশ্য এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে রয়েছে। ৫১০ জন আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর এই টিকা প্রয়োগ করা হবে। অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে তাঁদের টিকা শিগগিরই বাজারে আসবে। যদি টিকা আবিষ্কার হয়ে যায়, তাহলে সারা বিশ্বই করোনার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। বিশ্বের অন্য কয়েকটি দেশেও টিকা আবিষ্কারের গবেষণায় সাফল্যের কথা শোনা যাচ্ছে। এটা আজ বলা যায়, বিশ্ব করোনা-রোধী টিকা আবিষ্কারের খুব কাছাকাছি এসে গেছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে আরেকটি বিতর্ক চলছে। প্রশ্নটি আমাদের দেশের জন্য বেশ খাটে। এটা আমরা অনেকেই শুনেছি। কেউ বলেন গরমের দেশে করোনাভাইরাসের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া কঠিন। গরমের দেশে এদের দ্রুত সংক্রমণ সম্ভব নয়। অন্যদিকে আরেক দল বিজ্ঞানী বলছেন, করোনাভাইরাসের কাছে শীত-গরম কোনো ব্যাপারই না। এরা সব আবহাওয়ায় বাঁচে। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা গেছে করোনাভাইরাস এমনকি ৬৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডেও বেঁচে থাকতে পারে। তাহলে আমাদের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে করোনার তো কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

অন্য বিজ্ঞানীরা বলেন, করোনাভাইরাস ৬৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পর্যন্ত বেঁচে থাকলেও ওই ভাইরাসের পক্ষে গ্রীষ্মপ্রধান দেশে রোগের বিস্তার ঘটানো কঠিন। কারণ ওরা মূলত হাঁচি-কাশির সময় মুখ থেকে বের হওয়া ড্রপলেটের মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ায়। এই ড্রপলেটগুলো খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পানির কণা। তাই আবহাওয়ার তাপমাত্রা যদি বেশি থাকে, তাহলে কয়েক সেকেন্ডেই এই ড্রপলেটগুলো গরমে উবে যায়, তখন করোনাভাইরাস আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ভাইরাসটি মারা যায়। ফলে করোনা রোগ অন্যদের মধ্যে ছড়াতে পারে না। অবশ্য খুব কাছ থেকে হাঁচি-কাশি বা ছোঁয়াছুঁয়িতে সংক্রমণ ছড়ায়। কিন্তু রোগের ছড়িয়ে পড়ার গতি কমে যায়।

আমরা জানি না এ কারণেই আমাদের দেশে সংক্রমণ ছড়ানোর হার অন্য দেশের তুলনায় কিছুটা কম কি না। আরও সময় নিয়ে দেখতে হবে। অন্তত আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই বোঝা যাবে বিজ্ঞানীদের কোন কথাটি আমাদের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে খাটে।

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্সকিন্তু আমাদের পূর্ণ সতর্কতা মেনে চলতে হবে। আমরা যদি লকডাউন মেনে চলি, একে অপরের থেকে একটু দূরে থাকি, দিনে অন্তত ১০ থেকে ১৫ বার শুধু সাবান দিয়ে হাত ধুই, তাহলেই কোভিড-১৯ কুপোকাত। কারণ, তার আশ্রয় থাকবে না। এ অবস্থায় সে মারা যাবে। অবশ্য পিচঢালা বা পাকা রাস্তায় এরা প্রায় পাঁচ দিন পর্যন্ত বাঁচে। আক্রান্ত ব্যক্তি ঘরের বাতির সুইচ, টেবিল-চেয়ার স্পর্শ করলে সেখানেও ভাইরাসটি বেশ কয়েক ঘণ্টা বেঁচে থাকে। কিন্তু ক্ষারযুক্ত সাবান এর যম। কারণ, ভাইরাসটির চারপাশের আবরণটি যে লিপিড বা চর্বি জাতীয় পদার্থে ঢাকা থাকে, সাবানের স্পর্শে সেই লিপিড গলে যায় আর তখনই ভাইরাসটির মরণ। তাই সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোয়ার কোনো বিকল্প নেই।

এক অর্থে, যে করোনার ভয়ে আমরা কাবু, সেটা এক জায়গায় খুব দুর্বল। আর যেখানে সে দুর্বল, সেখানেই আমাদের আঘাত হানতে হবে। তাহলে করোনা আমাদের সহজে ধরতে পারবে না। এ জন্য দরকার লকডাউন মেনে চলা এবং সেই সঙ্গে প্রতিদিন আমরা যে সতর্কতা মেনে চলার কথা শুনছি, ওগুলো প্রত্যেকের জীবনের স্বাভাবিক চর্চার মধ্যে নিয়ে আসা।

আব্দুল কাইয়ুম: মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক
[email protected]





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar