ad720-90

আতিকুরের কাছের প্রযুক্তি দূরের দৃষ্টি


আতিকুর রহমান। ছবি: খালেদ সরকারপ্রযুক্তিবিশ্বের বড় একটি নাম ডেল ইএমসি। প্রতিষ্ঠানটির হয়ে বাংলাদেশে কান্ট্রি ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন আতিকুর রহমান। এর আগে কাজ করেছেন সিমেন্স ও মাইক্রোসফটে। পড়াশোনাও প্রযুক্তি বিষয়ে। কেমন তাঁর প্রযুক্তিজীবন?

‘প্রথম স্পর্শ’—জেমসের জনপ্রিয় একটি গান। সেই গানের এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘প্রথম ভালোবাসা তুলনাহীনা…’। আতিকুর রহমানের প্রথম মোবাইল ফোন ছিল সিমেন্সের সি১০। ভালোবাসার সেই প্রথম ফোনটি তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাই এখনো প্রিয় গ্যাজেটের মধ্যে ওই ফোনটি ওপরের দিকেই আছে। প্রথম ভালোবাসা তুলনাহীনা বলে কথা!

গত ২৪ নভেম্বর সকালে তেজগাঁওয়ের অফিসে বসে আতিকুর ফিরে গেলেন ২০০৭ সালের এক সন্ধ্যায়। তাঁর ভাষায়, ‘সেই সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা ছিল ভীতিকর!’

সে সময় সিমেন্স ছেড়ে সদ্যই মাইক্রোসফটে ব্যবসায় উন্নয়ন ব্যবস্থাপক (বাংলাদেশ ও নেপাল) হিসেবে যোগ দিয়েছেন আতিকুর। হরতাল চলছে। বাকিটা শুনুন তাঁর মুখে, ‘সেদিন গাড়ি নিয়ে বের হইনি। সন্ধ্যায় গুলশানের অফিস থেকে বেরিয়ে একটি অটোরিকশায় উঠেছি। তেজগাঁও কলেজের সামনে এসে টের পেলাম, ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছি। আমার হাতে তখন সিমেন্সের সি১০ আর ওটু ব্র্যান্ডের একটি ফোন। সামনে বিপদ আঁচ করে ফোন দুটি রক্ষার আশায় রাস্তায় ফেলে দিলাম। কিন্তু সব শেষে রাস্তায় আর প্রিয় ফোন দুটি খুঁজে পেলাম না!’

প্রথম মুগ্ধতা

হারিয়ে যাওয়া প্রথম ফোনটি আতিকুর পেয়েছিলেন সিমেন্সে পণ্য নির্বাহী পদে যোগ দেওয়ার পর। সেটা ২০০০ সালের কথা। এর আগে মোবাইল ফোনের সঙ্গে পরিচয় ১৯৯৬–৯৭ সালে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিকস বিভাগে পড়েন আতিকুর। বলছিলেন সে সময়ের কথা, ‘তখন আমাদের মধ্যে দু–একজন মাত্র মোবাইলফোন ব্যবহার করত। নতুন একটা গ্যাজেট, অন্য রকম উত্তেজনা সবার মধ্যে।’

তবে এই মোবাইল ফোন নয়, আতিকুরকে প্রথম মুগ্ধ করেছিল ইন্টারনেট। সেটাও ওই ১৯৯৬–৯৭ সালের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাপত্রের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাঠাগারে বসে থাকার বদলে এক সার্চেই দুনিয়া হাতের মুঠোয়। মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না আতিকুরের, ‘ইন্টারনেটের মধ্যেই প্রথম “ওয়াও ফ্যাকটর” খুঁজে পেয়েছিলাম। এক সার্চেই কত কিছু পাওয়া যায়—এ বিষয়টি মুগ্ধ করার জন্য যথেষ্ট। এ কারণে শিক্ষকদের ধন্যবাদ জানাতেই হয়। আমাদের ল্যাবটা সে সময় উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন বলেই প্রযুক্তিবিশ্বের সুবিধাগুলো আমরা পেয়েছিলাম।’

জীবন সহজ অ্যাপে

প্রযুক্তিবিশ্বের আরও অনেক সুবিধাই এখন উপভোগ করছেন আতিকুর রহমান। অনেকটাই দিচ্ছে মোবাইলফোন। আইফোন সিক্স প্লাস বলতে গেলে শরীরের অংশই হয়ে উঠেছে। কথা বলার ফাঁকে দেখা গেল, আতিকুরের ডান হাতে ফিটবিট আর বাঁ হাতে ঘড়ি। ঘড়িটি কোন ব্র্যান্ডের? স্মার্টওয়াচ ব্যবহার করেন? আতিকুর বললেন, ‘না, ফিটবিট ব্যবহার করলে স্মার্টওয়াচের দরকার হয় না। ঘড়ির মধ্যে আমার প্রিয় ট্যাগ হয়া আর রোলেক্স। এই ঘড়িটা ট্যাগ হয়ার।’

কম্পিউটারের বেলায় পছন্দের ব্র্যান্ড কোনটি—এই প্রশ্ন নিতান্তই বাহুল্য। ডেল ইএমসির কান্ট্রি ম্যানেজারের সামনে আর কোন কম্পিউটারই বা থাকবে! ‘বাসার ল্যাপটপটিও ডেলের।’ বলছিলেন আতিকুর, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আইবিএমের ৩৮৬এসএলসি কম্পিউটার দিয়ে শুরু করেছিলাম। তারপর সিমেন্সে থাকার সময় তোশিবা।’

সিমেন্স প্রসঙ্গই যখন এল, তখন আমাদের প্রশ্ন, ‘সিমেন্স কেন মোবাইলফোন উৎপাদন বন্ধ করে দিল?’ আতিকুর বললেন, ‘ওটা সিমেন্সের বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত ছিল। তবে সে সময় বাংলাদেশের বাজারে ৬০–৭০ শতাংশ শেয়ার ছিল সিমেন্সেরই। ফলে বাংলাদেশে আরও এক বছর ওরা মোবাইলফোন রেখেছিল।’

মোবাইলফোনে হোয়াটসঅ্যাপই বেশি ব্যবহার করেন আতিকুর। সিঙ্গাপুর অফিসের সঙ্গে প্রতিদিনই যোগাযোগ রাখতে হয়। গ্রুপচ্যাট, ভিডিও কল থেকে শুরু করে সবকিছুতেই হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর আস্থা। এরপরই আছে ভাইবার। ফেসবুক, লিংকড–ইনও ব্যবহার করেন প্রতিদিন। এয়ার বিএনবি, ফ্লাইট ট্র্যাকার অ্যাপগুলো চালাতে হয় মাঝেমধ্যেই। এ ছাড়া ডেলের নিজস্ব কিছু অ্যাপ চালাতে হয় দাপ্তরিক কাজের জন্য। কথার মধ্যে আমরা যখন ভিজিটিং কার্ড বিনিময় করলাম, আতিকুর সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলফোন দিয়ে কার্ডটি স্ক্যান করতে করতে বললেন, ‘এই কার্ড স্ক্যানার অ্যাপটিও খুব ব্যবহার করি। ক্যামস্ক্যানার অ্যাপটা বেশ কাজের। অফিসের কাগজপত্র স্ক্যান করতে আর বাইরে যাই না।’

অফিসের বাইরে যখন যান, মানে ঘরে বা অবসরে কোন অ্যাপগুলো খুলে বসেন? আতিকুর সংগীতপ্রিয়। তাই ইউটিউবই তাঁর সবচেয়ে প্রিয়, ‘ছাত্রজীবনে প্রচুর গান শুনতাম। বিলবোর্ড টপচার্টের সব গানই নিয়মিত শুনেছি। এখন ওই গানগুলোই ইউটিউবে শুনি। ভালো লাগে। আশি বা নব্বই দশকের ওই গানগুলো নস্টালজিক করে তোলে। আমার মনে হয়, ওই সময়ের গানগুলোর মতো এখন আর হয় না।’

প্রযুক্তির বর্তমান–ভবিষ্যৎ

তবে এখন তো অনেক কিছুই হচ্ছে, যা কেউ ভাবেনি আগে। ভবিষ্যতের গ্যাজেট কেমন হবে? আতিকুরের ধারণা এ রকম, ‘ভার্চ্যুয়াল রিয়ালিটি আরও উন্নত হবে। হলোগ্রাফিক প্রযুক্তি নতুন চমক দেখাবে। তিন–চার বছর আগেও আমরা যা ভাবতে পারিনি, তা কিন্তু এখন হচ্ছে। উবারের কথাই ধরুন। কেউ কি ভাবতে পারত, আমাদের গাড়ির চালকেরা স্মার্টফোন ব্যবহার করে উপার্জন করবেন? পারত না। সব শ্রেণি ও বয়সের মানুষ প্রযুক্তি গ্রহণ করছে, ভবিষ্যতে আরও বেশি করবে নিঃসন্দেহে।’

আতিকুরের পরিবারের নবীন সদস্যরা কীভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করছে? দুই মেয়ে তাঁর—১০ বছরের আয়ানা ও দেড় বছরের আলভিনা। দুজনই গ্যাজেট ব্যবহার করে। কিন্তু একটা ‘তবে’ যোগ করলেন আতিকুর, ‘বাচ্চারা গ্যাজেট ব্যবহার করবেই। আপনি ওদের বাধা দিতে পারেন না। তবে কিছু নিয়ম করে দিতে পারেন। আমিও সেটাই করছি।’ কথার ফাঁকে ছোট কন্যা আলভিনার সেলফি তোলার কিছু মুহূর্ত আতিকুর দেখালেন তাঁর মোবাইলফোনে। আর বললেন, ‘বাচ্চাদের বোঝালে সব বোঝে। প্রযুক্তির অতিব্যবহার ঠেকাতে হলে ওদেরকে বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে দিতে হবে। বাইরে যেতে দিতে হবে। বই পড়ার অভ্যাস করাতে হবে। আমার বড় মেয়েটা অনেক বই পড়ে। আমি নিজেও পড়ুয়া। তবে কিন্ডলে কিনে পিডিএফ পড়ার চেষ্টা করেছিলাম, ভালো লাগেনি। আমি এখনো কাগজের বইয়ের ভক্ত।’

আতিকুর বাংলাদেশি প্রযুক্তিকর্মীদের কাজেরও বড় ভক্ত। তাঁর কণ্ঠে আশার বাণী, ‘ভবিষ্যৎ চলবে সফটওয়্যারে। ফলে হার্ডওয়্যারে নয়, আমাদের উচিত সফটওয়্যার উৎপাদনে মনোযোগী হওয়া।’

আপনার স্বপ্নের প্রযুক্তি কোনটি? শেষ প্রশ্ন শুনে আতিকুর উত্তর দিলেন হাসিসহ, ‘আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস), বিগ ডেটা—এসবের সাহায্যে হিসাবনিকাশ এবং বিশ্লেষণ অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুব ভালো অনুমান করতে পারছি আমরা। এই প্রযুক্তি আরও উন্নত হবে। তাই আমার স্বপ্নের প্রযুক্তি এমন কিছু, যা আরও নিখুঁতভাবে ভবিষ্যৎ বলে দেবে।’

 





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar