ad720-90

বোলযম্যান ব্রেইন


বোলযম্যানের সমাধিকসমোলজিতে বোলযম্যান ব্রেইন পারাডক্স বলে একটা জটিল ও মজার সমস্যা আছে। কসমোলজি হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানের একটি শাখা, যেখানে আমাদের মহাবিশ্বের শুরু, বর্তমান অবস্থা এবং এর ভবিষ্যৎ এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা এবং এ–সম্পর্কিত গাণিতিক মডেল তৈরি করা হয়। মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা যেহেতু পূর্ণাঙ্গ নয়, সে জন্য স্বাভাবিকভাবেই এ বিষয়গুলো নিয়ে বহু ধরনের মডেল আছে। প্রত্যেকটা মডেলের কিছু সুবিধা এবং কিছু অসুবিধা আছে। তার মানে হচ্ছে, প্রত্যেকটা মডেল কিছু কিছু ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা দিতে পারে আবার কিছু ব্যাপারে পারে না। এ রকম কিছু মডেল আছে, যা ‘বোলযম্যান ব্রেইন’ (Boltzmann Brain) বলে একধরনের আত্মসচেতন পর্যবেক্ষকের অস্তিত্বের কথা বলে। বোলযম্যান ব্রেইন নামটা এসেছে বিশ্ববিখ্যাত অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ লুডউইগ বোলযম্যানের (Ludwig Boltzmann) নাম থেকে। আজকে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলব।

গত বেশ কয়েক মাস ধরে স্ট্রিং তত্ত্বের ওপর ধারাবাহিকভাবে লিখছি। এবার দৃষ্টি একটু অন্যদিকে ফেরাতে চাই। পদার্থবিজ্ঞানে বিভিন্ন মজার মজার প্যারাডক্স আছে। প্যারাডক্স হলো এমন একটা ব্যাপার বা বিবৃতি যা একটা বিশুদ্ধ ধারণা থেকে উদ্ভূত কিন্তু একটা পরস্পরবিরোধী উপসংহার দেয়। এবার এই প্যারাডক্সগুলো নিয়ে একটা ধারাবাহিক লেখা লিখতে চাই। আর পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, প্রথমে যে বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করতে চাই, তা হচ্ছে বোলযম্যান ব্রেইন পারাডক্স।

পদার্থবিজ্ঞানে কোনো ঘটনা না ইভেন্ট বর্ণনার জন্য আমরা পর্যবেক্ষক বা observer আছে বলে ধরে নিই। কল্পনা করা যাক, এক ধরনের অতিক্ষুদ্র, বুদ্ধিমান ও আত্মসচেতন পর্যবেক্ষক আছে। আমাদের শরীরবিহীন ব্রেইনটাকে এ ধরনের কিছু একটা ধরা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হচ্ছে, কোনোভাবে তা এককভাবে টিকে থাকতে পারে এবং জটিল চিন্তা করতে পারে। এ ধরনের ক্ষুদ্র, আত্মসচেতন পর্যবেক্ষককে বোলযম্যান ব্রেইন বলা হয়। এই অদ্ভুত ধারণাটার উৎপত্তি মূলত তাপগতিবিদ্যা (thermodynamics) থেকে। তাপগতিবিদ্যায় আমরা তাপ সাম্যাবস্থার কথা বলি। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, একটা পাত্রে গরম পানি রাখলে কিছুক্ষণ পর পাত্র ও পানির তাপমাত্রা এক হয়ে যায়। একে আমরা তাপ সাম্যাবস্থা বা thermal equilibrium বলি। তাপগতিবিদ্যার সাম্যাবস্থার সামান্য পরিবর্তন থেকে যদি কোনো আত্মসচেতন পর্যবেক্ষক জন্ম নেয়, তবে সেই অতি বিরল বস্তুটিকে বলা হয় বোলযম্যান ব্রেইন। ব্যাপারটি একটু জটিল। আস্তে আস্তে ব্যাখ্যা করা যাক। তবে শুরুতে পদার্থবিদ বোলযম্যান সম্পর্কে একটা তথ্য দেওয়া যাক।

লুডউইগ বোলযম্যানলুডউইগ বোলযম্যান আত্মহত্যা করেন ইতালির ত্রিএস্ত শহরের কাছে দুইনো বলে একটা জায়গায়। এই ত্রিএস্ত শহরেই আছে নোবেল বিজয়ী পাকিস্তানি পদার্থবিদ আবদুস সালামের স্থাপিত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ICTP। এড্রিয়াটিক সমুদ্রের পাড়ে, পাহাড় ঘেরা এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি অসম্ভব সুন্দর এবং পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করার এক অতি উৎকৃষ্ট জায়গা। এই ইনস্টিটিউটটি তৃতীয় বিশ্বের পদার্থবিদদের গবেষণাকে বিকশিত করার জন্য কাজ করে, সে জন্য বহু বাংলাদেশি পদার্থবিদের বিভিন্ন উপলক্ষে এখানে যাওয়ার এবং গবেষণা করার সুযোগ হয়েছে। আমি নিজে দুবার গিয়েছি। যাই হোক, বোলযম্যানের সমাধি হয় অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে তাঁর সমাধির পাথরখণ্ডে লেখা আছে ‘S= k log W’, এতটুকুই। পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, এই সমীকরণটি পদার্থবিজ্ঞানের অতি বিখ্যাত এক সমীকরণ। এই সমীকরণ এন্ট্রপির একটা পরিসংখ্যানভিত্তিক সংজ্ঞা। পদার্থবিজ্ঞানে বোলযম্যানের অর্জনের বিশালতা বোঝানোর জন্য এই অতি ক্ষুদ্র সমীকরণটিই যথেষ্ট। এটিই পদার্থবিজ্ঞানে বোলযম্যানের signature.

বোলযম্যানের আগে এন্ট্রপিকে ভাবা হতো কোনো একটা সিস্টেমের শক্তির একটা অংশ, যা দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ করা যায়। প্রয়োজনীয় কাজ ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করা যাক। একটা ইঞ্জিনের সংকুচিত পিস্টনের ভেতরকার গরম পেট্রল তখনই আয়তনে বৃদ্ধি পায়, যখন পিস্টনের চারদিকের পরিবেশের তাপমাত্রা কম থাকে। এ ক্ষেত্রে পেট্রল পুড়ে প্রয়োজনীয় কাজ হয়। যদি বাইরের তাপমাত্রা একই হতো তবে এমনটা হতো না। এটি মূলত তাপগতিবিদ্যার সাম্যাবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। একটা সিস্টেম সাম্যাবস্থা থেকে যত দূরে থাকে, তার এন্ট্রপি তত কম হয়। প্রত্যেকটা সিস্টেম সাম্যাবস্থার দিকে যেতে চায়। তার মানে হচ্ছে, একটা পৃথক (isolated) সিস্টেমের এন্ট্রপি সব সময় বাড়তে থাকে। এটাই তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র নামে পরিচিত। আর সাম্যাবস্থার দিকে সিস্টেমের ফিরে আশা তথা এন্ট্রপির এই বৃদ্ধিকে কাজে পরিণত করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন একটা সিস্টেম সাম্যাবস্থার দিকে যাবে? অন্যভাবে বললে কেন সিস্টেমের এন্ট্রপি সব সময় বৃদ্ধি পায়? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পাই বোলযম্যানের কাছ থেকে। আর সেই উত্তরেরই গাণিতিক রূপ হলো সমাধির টুম্বস্টোনে লেখা সমীকরণটি।

এখন বোলযম্যানের এই উত্তরটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই। একটা চিন্তা-পরীক্ষা দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। পাঠক একটা খালি কামরা চিন্তা করুন, যা কিনা অসংখ্য গ্যাস অণু দিয়ে পূর্ণ। এই গ্যাস অণুগুলো দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। এখন কোনো একটা সময়ে গ্যাস অণুগুলো যে অবস্থায় আছে তাকে আমরা বলতে পারি এর একটা কনফিগারেশন (configuration) বা অবস্থা। যেহেতু গ্যাস অণুগুলো ক্রমাগত ছুটে বেড়াচ্ছে কাজেই এ রকম অসংখ্য অবস্থা বা কনফিগারেশন হতে পারে। এবং অনেক অনেক সময় ধরে এটা ঘটলে গ্যাস অণুগুলোর প্রায় সব ধরনের সম্ভাব্য কনফিগারেশন নেওয়া হয়ে যাবে। লক্ষ করুন এই কনফিগারেশনগুলো আসলে বেশ কাছাকাছি ধরনের এবং তাদের ভেতর পার্থক্য করা মুশকিল। কিন্তু আমরা যদি এমন একটা কনফিগারেশন চিন্তা করি, যাতে কামরার সব গ্যাস অণু কোনো একটা কোনায় গিয়ে জমা হয়েছে, তবে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, তার সম্ভাবনা অনেক অনেক কম, প্রায় শূন্য। সহজভাবে বললে, এ ধরনের অতি ordered বা শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। একটু অন্যভাবে বললে এর মানে হচ্ছে, বিশৃঙ্খল অবস্থা পাওয়ার সম্ভবনাই বেশি। এ ধারণাকে ব্যবহার করে এন্ট্রপির একটা ভিন্ন ধরনের সংজ্ঞা দেওয়া যায়। আসলে এন্ট্রপিকে একটা সিস্টেমের disorder বা বিশৃঙ্খলার পরিমাপ হিসাবে ধরা যেতে পারে। আর এন্ট্রপি সব সময় বাড়ে, কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস অণুগুলোর অবস্থান আরও উল্টোপাল্টা, আরও বিশৃঙ্খল হতে থাকে। এন্ট্রপিকে এভাবে দেখার ফলে একটা মজার সম্ভাবনা দেখা দেয়। লক্ষ করুন, আমরা এখানে পুরো ঘরের সামগ্রিক এন্ট্রপি বেড়ে যাওয়া নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু এটা ঘরের একটা অতি ক্ষুদ্র অংশের এন্ট্রপির ওপর কোনো শর্ত আরোপ করছে না। ঘরের একটা খুব ক্ষুদ্র অংশে যদি আমরা দৃষ্টি দিই সেখানে কিন্তু এন্ট্রপি কমও হতে পারে। তার মানে হচ্ছে, সেখানে শৃঙ্খলা দেখা যেতে পারে, তবে পুরো ঘরের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা বাড়বে।

তবে শুরু থেকেই এই ধারণার বিরুদ্ধে পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছ থেকে কিছু আপত্তি আসতে থাকে। এ রকম একটা আপত্তি আসে আর্ন্সট জেরমেলো (Ernst Zermelo) নামের একজন জার্মান গণিতবিদের কাছ থেকে। জেরমেলো ‘Poincare recurrence theorem’ বলে একটা বিখ্যাত তত্ত্ব ব্যবহার করে এই আপত্তিটা তোলেন। Poincare recurrence theorem বলে কোনো একটা অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করার পর একটা সিস্টেম যদি যথেষ্ট পরিমাণ সময় ধরে বিবর্তিত হতে থাকে, তবে সিস্টেমটা একসময় তার শুরুর অবস্থায় চলে আসবে। বলে রাখি, এই তত্ত্বের সাধারণ (classical) এবং কোয়ান্টাম দুই ধরনের সংস্করণই আছে। আপাতত তাদের পার্থক্য সংক্রান্ত জটিলতায় যাচ্ছি না। বোলযম্যানের এন্ট্রপির ধারণার ক্ষেত্রে এটা মূলত যে সমস্যাটা তৈরি করে তা হচ্ছে, এই থিওরেম অনুযায়ী বেশি এন্ট্রপির কনফিগারেশনও একটা সময় পর কম এন্ট্রপির কনফিগারেশনে পরিবর্তিত হবে। কাজেই এটা তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র সরাসরি ভঙ্গ করে।

তবে বোলযম্যান কিন্তু বিশ্বাস করতেন যে জেরমেলোর এই সমালোচনাটা ঠিক না। তাই দ্বিতীয় সূত্র সংক্রান্ত এই জটিলতা থেকে বের হওয়ার জন্য বোলযম্যান বেশ কিছু প্রস্তাব করেন। বোলযম্যানের যে প্রস্তাবটি আমাদের বর্তমান ধারণার সবচেয়ে কাছাকাছি সেটা অনেকটা এমন—একটা অসীম বয়সের বিশ্বের জন্য তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রটি সব সময় ঠিক হবে না। কিন্তু যে বিশ্বের একটা শুরু আছে আছে তার জন্য দ্বিতীয় সূত্রটি সব সময় ঠিক। পাঠক লক্ষ করুন, যেহেতু এন্ট্রপি সব সময় বাড়তে থাকে, কাজেই বিশ্বের একটা শুরু থাকার অর্থ হচ্ছে এই শুরুতে তার এন্ট্রপি ছিল অতি অল্প। মজার বিষয় হচ্ছে, এই বিবৃতিটির একটা অন্য ধরনের তাৎপর্যও আছে। এখানে বলা হচ্ছে, আমাদের মহাবিশ্বের একটা শুরু আছে। বুঝতেই পারছেন এই বিবৃতির অর্থ খুবই গভীর। এটা আমাদের আজকের আলোচনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত না বলে আপাতত এদিকে যাচ্ছি না।

যাই হোক, বোলযম্যানের অন্য আরেকটা প্রস্তাব হলো এ রকম হয়তো আমাদের মহাবিশ্বের বয়স অসীম এবং এটি সাম্যাবস্থায় আছে। এই অবস্থায় মহাবিশ্বের এন্ট্রপি অনেক অনেক বেশি এবং তা সর্বোচ্চ। যেহেতু এই মহাবিশ্বের বয়স অসীম কাজেই গাণিতিক সম্ভাবনা কম হলেও কোনো একসময় কোনো এক খানে সাম্যাবস্থা থেকে এক অতি বিরল পরিবর্তনের (fluctuation) ফলে এন্ট্রপি এই সর্বোচ্চ এন্ট্রপি থেকে অনেক কমে যেতে পারে। আর আমরা এ ধরনেরই কোনো এক বিশ্বে বাস করি, যার এন্ট্রপি অনেক কমে গেছে। একটু অন্যভাবে বললে, যেহেতু মহাবিশ্বের বয়স অসীম ধরা হচ্ছে, তাই এমন হতে পারে যে একসময় এই মহাবিশ্বের সব কণা বা বস্তু একসঙ্গে একটা বিন্দুতে মিলিত হলো, অনেকটা ঘরের ভেতরের সব গ্যাসকণা একসময় এক কোনায় গিয়ে জমা হওয়ার মতো। এসব বস্তু কণার এক বিন্দুতে মিলিত হওয়ার ব্যাপারটাই কিন্তু কসমোলজির বিগ ব্যাং, বা আমাদের মহাবিশ্বের শুরু। এবং এই অবস্থায় এন্ট্রপি হবে অতি অল্প।

বোলযম্যান ব্রেইনের কল্পিত ছবি। ছবি: সংগৃহীতবোলযম্যান মূলত পয়েংকারের (Poincare) ধারণা ব্যবহার করেই জেরমেলোর আপত্তির একটা সমাধান দিলেন। এই ধারণাকে কেন্দ্র করে অগ্রসর হলে আমরা দেখতে পাব যে একটা সাম্যাবস্থায় থাকা বিশ্ব যাকে বলা যেতে পারে মৃত বিশ্ব কারণ তার এন্ট্রপি সর্বোচ্চ, তার ভেতরে এখানে–সেখানে অপেক্ষাকৃত ছোট জায়গা (যা কিনা একটা গ্যালাক্সির আকারের মতো হতে পারে) থাকা সম্ভব যা অল্প সময়ের জন্য সাম্যাবস্থা থেকে অনেক অনেক দূরে সরে গেছে। যেহেতু আমাদের বিশ্বের এবং এর ভেতরে মানুষের অস্তিত্ব আছে, কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি সত্যি সত্যিই সাম্যাবস্থা থেকে বিরল এক পরিবর্তনের ফলে অতি কম এন্ট্রপি অবস্থা তৈরি হয়েছে অর্থাৎ আমাদের মহাবিশ্বের শুরু হয়েছে এবং এ রকম কোনো কম এন্ট্রপির জায়গাতেই আমরা বাস করি বা করছি। ব্যাপারটিকে একটু অন্যভাবে দেখা যায়, আমরা পর্যবেক্ষক হিসাবে কেবল সেই পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বা অবস্থাই পর্যবেক্ষণ করতে পারি, যা আমাদের মতো পর্যবেক্ষক (অর্থাৎ মানুষ) তৈরি করতে পেরেছে। আমদের বা পর্যবেক্ষকের অস্তিত্ব না থাকলে তো আসলে এসব সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার কোনো প্রশ্নই নেই। এটাকে আমরা বলি এনথ্রপিক নীতি (Anthropic Principle)।

কিন্তু এই ধারণাতেও একটা বড় ধরনের সমস্যা আছে, যা বোলযম্যান ধরতে পারেননি। এই সমস্যাটা পদার্থবিদ আর্থার এডিংটন (Arther Eddington) প্রথম ধরিয়ে দেন। এডিংটন বলেন যে একটা ছোট বুদ্ধিমান পর্যবেক্ষকই তো যথেষ্ট, একটা পুরো গ্যালাক্সি বা মহাবিশ্ব এবং এর ভেতরে মানুষের দরকার কী। ব্যাখ্যা করা যাক, সাম্যাবস্থা থেকে অনেক বেশি দূরে যাওয়ার থেকে সাম্যাবস্থা থেকে কম দূরে সরে যাওয়াই গাণিতিক সম্ভাবনার দিক থেকে বিচার করলে অনেক বেশি সম্ভব। কাজেই গাণিতিক সম্ভাবনার হিসাবে, একটা সম্পূর্ণ গ্যালাক্সি থকে একটা গ্রহ তৈরি হওয়া অনেক বেশি সম্ভব। এই ধারণা নিয়ে অগ্রসর হতে থাকলে বলা যায়, পর্যবেক্ষক হিসাবে একটা মানুষ না হয়ে কেবল একটা আত্মসচেতন মস্তিষ্ক আরও বেশি সম্ভব। আর এই ছোট বুদ্ধিমান পর্যবেক্ষকই বোলযম্যান ব্রেইন নামে পরিচিত। গাণিতিক সম্ভাবনার বিচারে আমাদের এই মহাবিশ্ব এবং এর ভেতরে মানুষ থাকার চেয়ে অসংখ্য বোলযম্যান ব্রেইনের অস্তিত্ব থাকা অনেক অনেক বেশি সহজ। এই ধারণার অন্য একটা দিক আছে, আমরা যেভাবে নিজেদের ভাবি সেভাবে হয়তো আমাদের অস্তিত্বই নেই। আমরা হয়তো কেবলই বোলযম্যান ব্রেইন এবং এই ব্রেইন যেহেতু চিন্তা করতে পারে সে হয়তো ভাবছে সে মানুষ। হতে পারে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসাবে চিন্তা করা এই ব্রেইনের একধরনের ভ্রম। আসলে গ্যালাক্সি, মানুষ কিছুই নেই, আছে শুধু ভাসমান বোলযম্যান ব্রেইন, যারা এক অদ্ভুত ধরনের ভ্রান্তিবিলাস নিয়ে বেঁচে আছে, এই মহাবিশ্ব আছে ভাবছে, নিজেদের মানুষ ভাবছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

পাগলামি মনে হতে পারে, তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ধারণাটিকে ভুল প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। শন ক্যারল বলে একজন পদার্থবিদের একটা সুন্দর যুক্তি আছে এই ধারণার বিপরীতে। তাঁর মতে, ব্যাপারটিকে এভাবে ভাবা যেতে পারে। যদি আমরা আসলে বোলযম্যান ব্রেইন হই তাহলে আমরা এক অদ্ভুত ধরনের ভ্রমাত্মক জগতে বাস করছি। আর সেটা হলে তো আমরা ধরেই নিচ্ছি যে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে বোঝার, তাকে ব্যাখ্যা করার মানসিক শক্তিই আমাদের নেই। তা যেহেতু নয়, কাজেই আমরা সম্ভবত বোলযম্যান ব্রেইন না। যাই হোক, বিষয়টা পদার্থবিজ্ঞান ছাড়িয়ে অনেকটা দর্শনের মতো হয়ে যাচ্ছে। পাঠক লক্ষ করুন এই পুরো ধারণাটা কিন্তু আসছে বিং ব্যাং তথা আমাদের মহাবিশ্বের সৃষ্টিকে একটা random এবং বিরল এন্ট্রপির fluctuation হিসাবে চিন্তা করার জন্য। আর দিন শেষে এটা কিন্তু একটা গাণিতিক মডেল মাত্র, যা আদৌ সত্যি কিনা আমরা জানি না। কয়েক বছর আগে আমি নিজেও এই বিষয়ে কিছুটা গবেষণা করেছিলাম। কিন্তু সেখান থেকে সন্দেহাতীতভাবে বলার মতো কোনো উপসংহারে পৌঁছাতে পারিনি। এটা এখনো এই ধরনের কসমোলজিকাল মডেলের একটা বড় সমস্যা। এর কোনো উত্তর আছে কিনা, না এটা অবান্তর প্রশ্ন সেটা হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমরা জানতে পারব।

ড. সাজিদ হক: শিক্ষক ও গবেষক, স্ট্রিং থিওরি অ্যান্ড কসমোলজি, ইউনিভার্সিটি অব উইন্ডসর, কানাডা
ই-মেইল: [email protected]

লেখকের এ বিষয়ে আগের লেখা—
১. ‘থিওরি অব এভরিথিং’ 
২. প্রথম স্ট্রিং বিপ্লব 
৩. দশ-মাত্রিক মহাবিশ্ব ও সুপার স্ট্রিং তত্ত্ব 
৪. হলোগ্রাফি এবং পদার্থবিজ্ঞানের মেসি 

 





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar