ad720-90

অনেক প্রথমের সঙ্গী আলমাস


সৈয়দ আলমাস কবীর। ছবি: খালেদ সরকারবাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর। প্রযুক্তির ভুবনে দীর্ঘদিনের পথচলা তাঁর। যুক্ত আছেন বাংলাদেশের কম্পিউটার, প্রোগ্রামিং, ফাইবার অপটিক্যাল নেটওয়ার্কিংসহ আরও নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজের শুরুর দিক থেকে। নিজের প্রযুক্তিজীবনের শুরু থেকে বর্তমান দিনের নানান কথা বললেন তিনি। লিখেছেন মাহফুজ রহমান

জীবনের মাঠে হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন। জুলফিতে লেগেছে শুভ্রতার কিঞ্চিৎ ছোঁয়া। প্রথম দেখায় অবশ্য বয়স বোঝা মুশকিল। ফলে সৈয়দ আলমাস কবীরকে অনায়াসে ফোর-কে রেজল্যুশনের মতো ঝকঝকে বলা চলে। তাঁর চিন্তাও মুখশ্রীর মতো ঝকঝকে। উদাহরণ? সাক্ষাৎকারের একদম শেষ দিকে প্রশ্ন করেছিলাম, ভবিষ্যতের একটা প্রযুক্তির কথা বলুন। তিনি বললেন, ‘অনলাইনে গন্ধ নেওয়া যাবে, এমন একটা প্রযুক্তি আসা উচিত। আপনি হয়তো অনলাইনে ফুল কিনছেন, সেটারও গন্ধ পাবেন। যেকোনো গন্ধ আসলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার সমন্বয়। প্রিন্টারের রঙের মতো আরকি। রঙের মতো কেমিক্যালের কার্ট্রিজ থাকবে, সেখান থেকে নির্দিষ্ট মাত্রায় রাসায়নিক মিশে আলাদা আলাদা গন্ধ বেরিয়ে আসবে। ই-কমার্স এখন খুব জনপ্রিয়, তাই এই সুবিধা জরুরি হয়ে উঠেছে।’

এ ধরনের ঝকঝকে চিন্তার সূত্রপাত হয়েছিল আশির দশকে। ঠিকঠাক করে বললে ১৯৮২ সালের কথা। সৈয়দ আলমাস কবীর তখন সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে পড়েন। তাঁর মামা জার্মানি থেকে নিয়ে এলেন ‘প্যাক-ম্যান’ গেম কনসোল। কৈশোরের মুগ্ধতা এখনো কাটেনি, সেটা আলমাস কবীরের কথাতেই স্পষ্ট, ‘গেমটাতে যেভাবে যা বলতাম, তা-ই হতো। প্যাক-ম্যানকে ডানে যেতে বললে ডানে যায়, বাঁয়ে বললে বাঁয়ে। মোটকথা আমি মহামুগ্ধ। প্যাক-ম্যান খেলতে খেলতেই মনে হয়েছিল, আমিও তো এ রকম একটা গেম তৈরি করতে পারি। তাহলে কী করতে হবে? প্রোগ্রামিং শিখতে হবে।’

২.

১৯৮৪ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর আলমাস ঠিক করলেন দুটি কাজ করবেন। এক. প্রোগ্রামিং শিখবেন এবং দুই. নতুন একটা ভাষা শিখবেন। জার্মান ভাষা শিখতে ভর্তি হলেন গ্যেটে ইনস্টিটিউটে। আর প্রোগ্রামিং শিখতে চলে গেলেন ধানমন্ডির এক প্রতিষ্ঠানে। শুরু হলো বেসিক প্রোগ্রামিং শেখা। সেই সুবাদে হাতে পেলেন ২০ কিলোবাইট র‌্যামের কমোডর কম্পিউটার। সেটি দেখতে ছিল ঠিক কি-বোর্ডের মতো। তথ্য সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না তাতে। আর প্রথম ডেস্কটপ কম্পিউটারের সঙ্গে মোলাকাত হলো ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার পর। ১৯৮৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে আলমাস এলেন ঢাকায়। তখনো পরীক্ষার ফল পাননি, প্রোগ্রামার হিসেবে যোগ দিলেন ফ্লোরা কম্পিউটার্সে। সেসব দিনের কথা বলছিলেন আলমাস, ‘বাংলাদেশে তখন এপসনের পিসি প্রথম প্রথম আসছে। ফ্লোরা আনছে, আরও অনেকে আনছে। তো কাজের জন্য প্রথম একটি কম্পিউটার পেলাম। হার্ডডিস্ক ১০ মেগাবাইটের। বেশ মোটাসোটা। দুই মাস পর পেলাম ২০ মেগাবাইট হার্ডডিস্ক। দারুণ রোমাঞ্চিত আমি। সবাইকে ফোন করে জানাতে শুরু করলাম, “শোনো, ২০ মেগাবাইট হার্ডডিস্কের কম্পিউটার চালাচ্ছি!” হা হা হা!’

ফ্লোরাতে ভালোই করছিলেন আলমাস। মাস তিনেক পর অবশ্য যোগ দিলেন কনকর্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। তত দিনে বর্তমানের হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর ও জাতীয় স্মৃতিসৌধের মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থাপনার কাজ করে ফেলেছে প্রতিষ্ঠানটি। বেশ নামডাকওয়ালা ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রথম দুটি কম্পিউটার কিনলেন আলমাস। বেশ কয়েকটি প্রোগ্রামও তৈরি করে ফেললেন অল্প কিছুদিনের মধ্যে।

৩.

১৯৯০ সালের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রে উড়ে গেলেন আলমাস। ভর্তি হলেন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে। বিষয় ছিল ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম। পড়াশোনার মাঝেই কিনে ফেললেন কম্পিউটার। টুকটাক কাজ আর গেম খেলা চলল নিয়মিত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনোর পর, ১৯৯২ সালে যোগ দিলেন মার্কিন মুলুকের বিখ্যাত প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান রেডিওশ্যাকে। আইবিএমও কমপ্যাকের পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানও তখন কম্পিউটার ও প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন করছে ধুমসে। আলমাস সেই প্রতিষ্ঠানটির নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি ও কানেটিকাট রাজ্যের বিক্রয়োত্তর সেবার সুপারভাইজার হিসেবে কাজ শুরু করলেন। প্রায় রোজ নতুন নতুন কম্পিউটারের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানোর সুযোগও পেয়ে গেলেন সেই সূত্রে।

১৯৯৫ সালে দেশে ফিরে আসার পর পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। ঢাকায় তত দিনে এসে গেছে এক গিগাবাইটের হার্ডডিস্ক। দাম ৩০ হাজার টাকা। পাওয়া যায় ড্যাফোডিল কম্পিউটার্সে। আলমাস বলছিলেন, ‘আনন্দ সিনেমা হলের উল্টো দিকের ছোট্ট একটা দোকান ছিল ড্যাফোডিলের। আমি গেলাম ওই হার্ডডিস্ক কিনতে। আগাম টাকা দিতে বলল। পরে অবশ্য আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুই গিগাবাইটেরটা কিনে এনেছিলাম।’

এক স্মৃতি আরেক স্মৃতি টেনে আনে। যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে একটি স্পেশাল ইন্টারেস্ট গ্রুপের (এসআইজি) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আলমাস। সমমনাদের আড্ডাখানা যাকে বলে। নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট বিষয়ে আগ্রহীরা যে যার সমস্যা নিয়ে কথা বলতেন। প্রযুক্তিপণ্যের বিনিময়ও হতো। তবে মজার ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্রের আগে বাংলাদেশে থাকতেই এমন এক ছোট্ট দলের সদস্য ছিলেন আলমাস। বলছিলেন ১৯৮৯-৯০ সালের কথা, ‘সে সময় ঢাকায় ও রকম একটি দল ছিল আমাদের। নাম ছিল মাইক্রো কম্পিউটার ইউজার গ্রুপ। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে আমরা কজন বসতাম, আড্ডা-টাড্ডা হতো। মাগ মিট বলতাম সেটাকে। তখন কম্পিউটার নিয়ে কাজ করে হাতে গোনা কয়েকজন, ১০ জনও নয় সংখ্যাটি। তাঁদের মধ্যে ছিলেন এখনকার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ভাই, পদার্থবিদ মুনিম রানাসহ আরও কয়েকজন। সেখান থেকে আমরা প্রথম প্রযুক্তিবিষয়ক নিউজলেটারও প্রকাশ করতাম! ছাপানো হতো সাইক্লোস্টাইল মেশিনে। প্রথমে দুই পাতা, পরে চার পাতার করে বের করা হতো। সেগুলোর কোনো সংখ্যাই এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না। ভীষণ আফসোস হয় ভাবলে।’

৪.

১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে (আইইউবি) যোগ দেন আলমাস। জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হিসেবে শুরু করলেন কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়াতে। মোটে চারজন শিক্ষার্থী। সেখানকার কম্পিউটার সেন্টারের ইনচার্জের দায়িত্বও বর্তাল আলমাসের কাঁধে। কয়েক বছরের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে কয়েক শ হলো। আইইউবির ক্যাম্পাস তখন বারিধারার পাঁচটি বাড়িতে ছড়ানো-ছিটানো। পাঁচটি ভবনকে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কে এক করলেন আলমাস। ‘ডটবিডি’ দিয়ে প্রথম ডোমেইনের ব্যবহার শুরু করলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির হয়ে। দেশে অনলাইন ইন্টারনেট চালু হয় ১৯৯৬ সালে। তবে ১৯৯৫ সালেই আইইউবিতে অফলাইন ই-মেইলের ব্যবস্থা করেছিলেন আলমাস। প্রযুক্তিতে অনেক প্রথমই তাঁর হাত ধরে।

আইইউবিতে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের সফল অভিজ্ঞতা থেকে সাহস পেলেন আলমাস। বন্ধুর প্রস্তাবে পুরো ঢাকা শহর ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের আওতায় আনার চিন্তা মাথায় ঢুকল। একদিন খেতে খেতে ন্যাপকিনের ওপরই করে ফেললেন নকশা। শুরু হলো মেট্রোনেটের। দেশে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক দিয়ে ডেটা কমিউনিকেশনের যাত্রা শুরু হলো সেখান থেকেই। ২০০১ সালের কথা সেটি। ২০০৬ সালে আলমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিলেন। পুরোপুরিভাবে যোগ দিলেন মেট্রোনেটে। ২০০৮ সালের পর পুরো দেশই ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসেন সৈয়দ আলমাস কবীর ও তাঁর সঙ্গীরা।

৫.

১৯৯৭ সালে গ্রামীণফোনের শুরু। তখনই সিমেন্সের একটি সেট হাতে পেয়েছিলেন আলমাস। এর আগে বিপার (পেজার নামেও পরিচিত) ব্যবহারের অভিজ্ঞতাও ছিল। তারও আগে রেডিওশ্যাকে থাকতে ব্যবহার করতেন একটি অর্গানাইজার গ্যাজেট। আইফোন আসার পর স্মার্টফোনের বাজারে বিরাট পরিবর্তন আসে। ব্যবহারও যায় বেড়ে। তবে ২০০২ সালে লন্ডন থেকে ওটু ব্র্যান্ডের একটি ফোন কিনেছিলেন আলমাস। সেটি চলত উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে। সেই থেকে উইন্ডোজপ্রেম শুরু। প্রেম টিকেছিল মাস ছয়েক আগ পর্যন্তও। আলমাসের বক্তব্য, ‘আমি মনে করি, উইন্ডোজ সেরা। অ্যান্ড্রয়েড বা আইফোন কখনো ব্যবহার করিনি। এখন গুগলের ফোন ব্যবহার করছি। এটাও ভালো, কিন্তু ওই যে বললাম, উইন্ডোজ সেরা। যখন শুনলাম, বিল গেটস নিজেও লুমিয়া ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছেন, তখন আমারও মনে হলো অন্য ফোন হাতে নিয়ে দেখি। আর কম্পিউটার বলতে এখন ব্যবহার করছি মাইক্রোসফটের সারফেস। দারুণ সন্তুষ্ট এটি ব্যবহার করে। মাইক্রোসফটের প্রতি দুর্বলতা আমার আছেই।’





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar