ad720-90

একটি ভিআর ছবি তৈরির গল্প


ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি তৈরি হচ্ছে ধাপে ধাপে। ছবি: সংগৃহীত৩৬০ ডিগ্রি বা ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি ফিল্ম হবে প্রচলিত ধারার সিনেমার ভাষা বা চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রযুক্তির মরণঘণ্টা—স্টিভেন স্পিলবার্গ।

চাপা উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছি আমরা কয়েকজন। সবার চোখ সামনের কম্পিউটার পর্দার দিকে। সেখানে আমাদের ধারণ করা অভিনব ফুটেজ সম্পাদনা চলছে। প্রথমবারের চেষ্টা ভেস্তে গেছে অভাবনীয়ভাবে। এবার আমাদের শেষ সুযোগ! শার্লট ফুটেজ নিয়ে কাজ করে চলেছে শান্ত ভঙ্গিতে। ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি বা ৩৬০ ডিগ্রি চলচ্চিত্র সম্পাদনায় এরই মধ্যে হাত পাকিয়ে ফেলেছ ইংরেজ এই তরুণী।

‘তোমরা কি এই জায়গায় একটা “মিউজিক” চাও?’ কাজের ফাঁকে জানতে চাইল শার্লট।

‘এটা অপহরণের ঠিক পরের দৃশ্য তাই না? থ্রিলার ধাঁচের একটা মিউজিক হলে ভালো হয়। নাকি?’

পাশ থেকে বলল হার্ভে।

অবশ্যই। তাহলেই না বোঝা যাবে এরপর আরও ভয়ংকর একটা কিছু ঘটতে চলেছে। মিউজিকটাও সে রকম পিলে চমকানো হওয়া চাই। সায় দিলাম আমরা বাকিরা।

ডিসেম্বর, ২০১৭। লন্ডনের প্রাণকেন্দ্রে ৩৬০ ডিগ্রি সিনেমা তৈরির প্রশিক্ষণ নিতে একজোট হয়েছি আমরা নানা প্রান্তের চারজন মানুষ। খ্যাতিমান নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলানের গুরু এলিয়ট লন্ডন রেইনড্যান্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের পুরোধা। সিনেমার অগ্রসর প্রযুক্তি নিয়ে সব সময় আগ্রহী এলিয়ট। তাঁর উদ্যোগেই মূলত আমাদের এই ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটিতে সিনেমার গল্প বলার অভিযান। প্রশিক্ষক হিসেবে আছেন জনি জে। জনি পৃথিবীর সেই বিরল টেকনিশিয়ানদের একজন, যিনি ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি বা ৩৬০ ডিগ্রি চলচ্চিত্র তৈরিতে বিশেষজ্ঞ। আমাদের তালিম চলছে জনির তত্ত্বাবধানেই। তত্ত্বীয় পড়ালেখা শেষ করেছি আগে। তারপর অপেক্ষায় ছিলাম কখন আসবে হাতে-কলমে ৩৬০ ডিগ্রি ছবি ধারণ করার সুযোগ।

অবশেষে এসেছে সেই মুহূর্ত। কিন্তু…। ছবির নাম বার্থডে সারপ্রাইজ। একটামাত্র সিকুয়েন্সে বলতে হবে পুরো গল্প। ঝটপট মোটামুটি একটা গল্প দাঁড়িয়ে গেল। (বলা বাহুল্য এখানে গল্প নয়। কীভাবে ৩৬০ ডিগ্রি পরিবেশে চলমান দৃশ্য ধারণ যায়, সেটা শেখাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য)। ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় দৃশ্য ধারণ শেষ হলো। তারপর সম্পাদনায় আরও ঘণ্টাখানেক। অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। প্রজেক্টর চালু হলো। ছবি শুরু হলো। কিন্তু একি! ছবি তো আর ছবি নেই। মাঝখান থেকে কে যেন আধা ফালি কেটে ফেলেছে ছবির দৃশ্য। ছবির চরিত্রদের কারও ঘাড় আছে তো মাথা নেই। মাথা আছে তো ঘাড় নেই।

জনি ছবি দেখে ‘ফোঁস’ করে হতাশাসূচক একটা শব্দ করল। তারপর জানাল, ‌আমাদের ‘স্টিচিং’ ঠিক হয়নি। ‘স্টিচিং’ মানে সোজা বাংলায় ‘সেলাই’। প্রথাগত সিনেমায় আমরা যেটাকে বলি এডিটিং বা সম্পাদনা, সেটাই ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি সিনেমায় ‘স্টিচিং’ বা সেলাই। কারণ এখানে একই সঙ্গে ক্যামেরা আগে-পিছে, ওপর–নিচে যাবতীয় সবকিছু ধারণ করে। তারপর সব দিক জোড়া দিয়ে তৈরি হয় একটি দৃশ্য। সেই দৃশ্য অ্যাপসের সহায়তায় ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি গিয়ার দিয়ে উপভোগ করা যায়। আবার ৩৬০ ডিগ্রি ভিডিও হিসেবে ইউটিউব বা অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম থেকেও দেখা যেতে পারে।

যা–ই হোক, হয়নি মানে পরদিন আবারও শুরু। এবারে নতুন দল। ছবির গল্প নতুন। প্রস্তুতি আর দৈর্ঘ্যও আগেরটার বেশি। ছবির নাম আমরা দিলাম থিংস ইউ সো। শার্লটের নেতৃত্বে ঝটপট সম্পাদনা হয়ে গেল। তারপর ছবিটা প্রজেকশনের পালা।

প্রজেক্টরের আলো জ্বলল। এবারে? নাহ্! আর কোনো ভুল নেই। শার্লট দারুণ কাজ দেখিয়েছে। মাউসের সহায়তায় পুরো ৩৬০ ডিগ্রি ঘোরা যাচ্ছে একটি দৃশ্যের। মানে, যে দিক থেকে খুশি একটা দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। আর অভাবনীয় ব্যাপার একটাই আবিষ্কার করলাম—আদতে হয়তো ছোট্ট একটা দৃশ্য কিন্তু মাউস বা কারসর ঘুরিয়ে দিক আর অ্যাঙ্গেল পরিবর্তনের সঙ্গে একই দৃশ্য হাজির হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন ‘ফিল’ নিয়ে। কোন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবিটা দেখবেন, সেটা পুরোটাই দর্শকের স্বাধীনতা। স্পিলবার্গ তাহলে খুব মিছে বলেননি?

৩৬০ ডিগ্রি ছবির অভিযান

ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি বা ৩৬০ ডিগ্রি ফিল্ম নিয়ে আগ্রহ জন্মায় ২০১৬ সালে। সে বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখেছিলাম দুটি ভিআর (ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি) সিনেমা। সেই অভিজ্ঞতা একজন সাংবাদিক ও নির্মাতা হিসেবে আমাকে বড় ধরনের নাড়া দিয়েছিল। তারপর থেকে এই নিয়ে পড়ালেখা আর জানা–বোঝার শুরু। চলমান প্রযুক্তির ক্যামেরায় শুধু ৯০ ডিগ্রি বা সর্বোচ্চ ১৮০ ডিগ্রি হয়তো ধরা (কাভার করা) সম্ভব। কিন্তু ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি বা ৩৬০ ডিগ্রি ক্যামেরা দৃশ্য ধারণ করে একযোগে সব দিক থেকে। তারও চেয়ে বড় কথা এখানে ‘বিহাইন্ড দ্য সিন’ বা লুকানোর কোনো জায়গা থাকে না। কয়েক বছর এই নতুন ধরনের সিনেমা প্রযুক্তি নিয়ে তাত্ত্বিক পড়ালেখা করেছি। কিন্তু বুঝেছিলাম, হাতে–কলমে কোনো কাজ না করা পর্যন্ত সবই অর্থহীন। ২০১৬ সালে লন্ডনযাত্রা এনে দিল সেই সুযোগ।

হাঁকিছে ভিআর ভবিষ্যৎ

শুরুতে কারিগরি সীমাবদ্ধতার কারণে বেশ ছোট দৈর্ঘ্যের ছবি হলেও ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটেতে গত বছরেই তৈরি হয়েছে পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি। অস্কার বিজয়ী মেক্সিকান পরিচালক আলেহান্দো গনজালেস ইনারিতু তৈরি করেছেন বড় পরিসরে ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি সিনেমা। ৩৬০ ডিগ্রি প্রযুক্তিতে বেশ কিছু কাজ হচ্ছে তথ্যচিত্র লেভেলে। কিন্তু এই ফরম্যাটে কাহিনিচিত্র বা গল্প বলার চেষ্টা লন্ডনের মতো শহরেও এখনো নতুন ফেনোমেনন। আর বাংলাদেশে তো বটেই। থিংস ইউ সো সাদাচোখের দেখায় খুবই সংক্ষিপ্ত একটি ছবি। এটি যতটা না প্রথাগত ছবি, তার চেয়ে বেশি ‘পরীক্ষণ’।

৩৬০ ডিগ্রি বা ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি ছবি নিয়ে নিশ্চয়ই বাংলাদেশেও অনেক কাজ হবে। আমাদের তরুণেরা নতুন এই মাধ্যমে গল্প বলার চ্যালেঞ্জ বিজয়ী হবে, এটাই প্রত্যাশা।

 





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar