ad720-90

শর্ত প্রযোজ্য


কোনো অফার দেখে স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ কিনতে যাওয়ার বা রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ার আগে কোথাও ‘শর্ত প্রযোজ্য’ লেখা আছে কি না খেয়াল করেন নিশ্চয়ই? মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটের জন্য পণ্যের মূল্যের সঙ্গে থাকা ++ (প্লাস প্লাস)। পাশাপাশি পণ্য ও সেবার সঙ্গে থাকতে পারে ‘ভ্যাট প্লাস’ নামের কিছু শর্ত। ‘একটার সঙ্গে আরেকটা বিনা মূল্যে’—স্মার্টফোন কেনা বলেন বা যদি রেস্তোরাঁয় খাবারের বেলায় এমন অফার হয়, তো কথাই নেই! দলবল নিয়ে অনেকেই ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেদার খাওয়ার পর বা নতুন যন্ত্র কেনার পর বিল দিতে গিয়ে হতভম্ব হওয়ার পালা। রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে ভ্যাট দেওয়ার পাশাপাশি ছোট্ট করে তারকা দিয়ে ‘শর্ত প্রযোজ্য’ কথাটি খেয়াল করেন না অনেকেই। এরপর আছে মোবাইল বা প্রযুক্তিপণ্য কেনাবেচার বা মোবাইল সেবার ক্ষেত্রে নানা রকম শর্ত। এই শর্তের মধ্যেই এমন অনেক কিছুই থাকে, যা আপনার পকেট থেকে বাড়তি অর্থ বের করে নেয়। তাই কোনো পণ্য কেনার আগে বা রেস্তোরাঁয় খাওয়ার আগে ওই ছোট ‘শর্ত প্রযোজ্য’ লেখাটির গুরুত্ব বুঝে নিতে হবে। জেনে নিতে হবে কী সেই শর্তগুলো। 

অনলাইন ও ফেসবুকে একটি রেস্তোরাঁর দেওয়া ১৫ শতাংশ ছাড়ের বিষয়টি চোখে পড়ে। ছাড়ের জন্য বেশ কিছু শর্ত দেয় তারা। শর্ত হিসেবে লেখা রয়েছে—প্রতি সপ্তাহের রবি-মঙ্গলবার যেকোনো দিন দুপুরে যেতে হবে। অফার শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য। মেয়াদ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। এক আইডিতে চারজন খেলে তবে ছাড় মিলবে। আইডি না থাকলে ছাড় নয়। এখন কেউ যদি এসব শর্ত না জেনে অফার ভেবে খেয়ে বসেন, তবে তাঁকে বাড়তি টাকা গুনতেই হবে। 

সম্প্রতি এমনই এক ঘটনায় পড়েন মতিঝিল এলাকার নাজমুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সস্তার তিন অবস্থা। অফার দেখে খেতে গিয়েছিলাম। শর্ত প্রযোজ্য লেখা খেয়াল করিনি। তাই অতিরিক্ত বিল দিতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পকেটে বাড়তি টাকা না থাকলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। তবে এখন অধিকাংশ রেস্তোরাঁয় সার্ভিস চার্জ বা বাড়তি খরচের বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়।’ 

খিলগাঁও এলাকার ফারজানা বৃষ্টি বলেন, ‘খিলগাঁও এখন রেস্তোরাঁপাড়া হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এলাকার অধিকাংশ রেস্তোরাঁয় কিন্তু সার্ভিস চার্জ বা বাড়তি শর্তের বিষয়গুলো নেই। তবে দু-একটা রেস্তোরাঁয় অফারের সময় কিছু শর্ত থাকতে পারে। ক্রেতাদের আগে জেনে নেওয়া উচিত।’ 

এখন স্মার্টফোনসহ প্রযুক্তিপণ্য কিনতে গেলেও অফারের সঙ্গে থাকে নানা শর্ত। অনলাইন কেনাকাটার ক্ষেত্রেও নানা অফারে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। এসব শর্ত না জেনে অনেকেই প্রযুক্তিপণ্য কিনতে গিয়ে ধরা খান। ল্যাপটপ কেনার সময় সম্প্রতি অফারের ফাঁদে পড়েছিলেন মেজবাউল ইসলাম। ছাড়ে ল্যাপটপ কেনার সময় শর্ত প্রযোজ্য বিষয়টি খেয়াল করেননি তিনি। শেষে বাজার যাচাই না করে কেনার ফলে ছাড়ের অফার সত্ত্বেও তাঁকে বেশি টাকা দিয়ে ল্যাপটপ কিনতে হয়েছে। 

এখনকার পত্রিকা, টিভি, অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও নানা অফারে চোখ চলে যায়। কিন্তু শর্ত প্রযোজ্যর ওই ছোট্ট লেখাটিতে চোখ যায় না। অনেক সময় মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনেও এমন অফার চোখে পড়ে। মোবাইল সিম, ভয়েস কলের বিভিন্ন অফার, ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনতে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীকে বিভিন্ন শর্তের মুখোমুখি হতে হয়। বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, এসব শর্ত মেনেও নেন গ্রাহক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে না পড়েই তা মেনে নিয়ে পণ্য বা সেবা ক্রয়ের পরে ব্যবহারের সময় নানা সমস্যায় পড়ার পর ভুল বুঝতে পারেন। অনেক সময় হঠাৎ মোবাইল ফোন অপারেটর থেকে কল করে বা এসএমএস পাঠিয়ে নানা অফার দেওয়া হয়। সেখানেও থাকে শর্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘শর্ত প্রযোজ্য’ নিয়ে প্রতারণার শিকার হওয়ার কথা বলেন অনেকেই। 

এ প্রসঙ্গে সিম্ফনি মোবাইলের পণ্য ও বিপণন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ রিয়াদ বলেন, ‘প্রযুক্তিপণ্যে ভ্যাটের পাশাপাশি বাড়তি অর্থ নেওয়া খুচরা বিক্রেতার সঙ্গে গ্রাহকের সম্পর্কের বিষয়। তবে সিম্ফনির মতো ব্র্যান্ডের পক্ষ থেকে আমরা সব সময় সেলস চ্যানেলকে গ্রাহক সন্তুষ্টির বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যবসা করতে উদ্বুদ্ধ করি। শর্ত প্রযোজ্য বিষয়টি মূলত দুটি ক্ষেত্রে হতে পারে। এক সেবা ও দুই নির্দিষ্ট প্রচারণা। এটি সিম্ফনি এমনভাবে প্রয়োগ করে, যাতে গ্রাহক-স্বার্থ সব সময় ঠিক থাকে। ব্যবসায়িক দিক থেকে যেসব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব হবে কেবল সে শর্ত দেওয়া হয়। যেমন কোনো হ্যান্ডসেট যদি পানিতে পড়ে গিয়ে ক্ষতি হয় সেটি সার্ভিস ওয়ারেন্টির আওতার মধ্যে না পড়তেও পারে। সব ধরনের পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে শর্ত থাকলে তা গ্রাহকের জেনে নেওয়া উচিত।’ 

 বনানীর ট্রি হাউস রেস্তোরাঁর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ সালমান বলেন, ‘অনেক রেস্তোরাঁ ভ্যাটের পাশাপাশি বাড়তি সার্ভিস চার্জ দাবি করে। এ ছাড়া অনেক সময় অফারে শর্ত বা গোপন চার্জ নেয়, যা ঠিক নয়। এতে ভ্যাটের সঙ্গে বাড়তি ২০-২৫ শতাংশ খরচ ক্রেতাকে দিতে হয়। আমাদের ক্রেতারা তাঁদের অধিকার নিয়ে সচেতন নন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। ক্রেতাকে শর্তের মাধ্যমে ফেলে বিভ্রান্ত করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার থেকে নির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকা প্রয়োজন।’ 

এবারের বাজেটের পর অস্থায়ী রেস্তোরাঁ ছাড়া সব ধরনের রেস্তোরাঁয় এখন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বসেছে। বেষ্টনী ও বৈদ্যুতিক পাখা নেই, শুধু দুটি বাতি আছে এমন রেস্তোরাঁর খাবারের বিলের ওপর কোনো ভ্যাট নেই। ফুটপাতের রেস্তোরাঁয় সাধারণত বেষ্টনী ও পাখা থাকে না। এসব রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়া করলে ভ্যাট দিতে হবে না। নতুন ভ্যাট আইনে রেস্তোরাঁর সংজ্ঞায় এসব কথা বলা হয়েছে। তবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত নয় কিন্তু বেষ্টনী ও বৈদ্যুতিক পাখা আছে, এমন রেস্তোরাঁয় খাবারের বিলের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁয় ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসবে। ফাস্ট ফুডের দোকানের ক্ষেত্রে একই শর্ত আরোপ হবে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ফাস্ট ফুডের দোকানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসবে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত নয় এমন ফাস্ট ফুডের দোকানে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। শ্রেণিভেদে কফি শপেও একই হারে ভ্যাট বসবে। ভ্যাট আইনটি ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে। 

সিক্স সিজনস হোটেলের সহকারী রেস্তোরাঁ ব্যবস্থাপক তাহসিন সানি বলেন, ‘রেস্তোরাঁয় বিল দেওয়ার সময় কিছু সমস্যা হয় ভ্যাট ও সার্ভিস চার্জ নিয়ে। এসব সমস্যা এড়াতে মেনুটা আগে পড়ে সেখানে এসব বিষয় উল্লেখ আছে কি না দেখতে হবে। না থাকলে নিজের উদ্যোগে প্রশ্ন করে জেনে নিতে হবে। কোন কোন ক্রেডিট কার্ডে কোন অফার তা জানার পাশাপাশি দাম জানতে হবে। ভ্যাট ও সার্ভিস চার্জ আলাদা কি না পরিষ্কার হয়ে নিতে হবে। এ ছাড়া ড্রিংকসের বিষয়টি জেনে নিতে হবে। আগেভাগে বুকিং দেওয়ার সময় জেনে নিয়ে গেলে ভালো।’ 

ভোক্তার করণীয়?

এসব ব্যাপারে ভোক্তার আসলে কী করার আছে? বললেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (গবেষণাগার) প্রণব কুমার প্রামাণিক—‘রেস্তোরাঁ বা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে যে সেবাগুলো দেওয়া হবে সেগুলোর মূল্যতালিকা প্রদর্শন করতে হবে। অবশ্য ভাত বা এ ধরনের খোলা খাবারের ক্ষেত্রে দাম ভোক্তা নির্ধারণ করবে। ভ্যাটের ক্ষেত্রে সব নিয়ম জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের ভ্যাট আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে। এ ক্ষেত্রে অন্যথা হওয়ার সুযোগ নেই। যেখানে শর্ত প্রযোজ্য লেখা
থাক না কেন, ক্রেতাদের কাছে কতটুকু দাম নিতে চান তার ঘোষণা থাকতে হবে।’

পণ্য কেনা বা সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে ভোক্তাদেরও অনেক দায়দায়িত্ব আছে বলে জানান প্রণব কুমার। যেমন ক্রেতাদের দেখেশুনে ও বুঝে পণ্য কিনতে হবে। কোনো দিকে প্রতারিত হচ্ছেন কি না সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের সচেতনতাই মূল। এরপরও যদি কোনো শর্ত বা অফারে গ্রাহক প্রতারিত বোধ করেন, তবে ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ দিতে পারবেন। 

ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯-এর ধারা ৪০ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা, ভেজাল পণ্য বিক্রি, পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা, খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণ, ওজনে কারচুপি, প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করার মতো ঘটনায় অভিযোগ দেওয়া যাবে। লিখিত অভিযোগ সরাসরি, ডাকযোগে বা ফ্যাক্স, ই-মেইলের মাধ্যমেও দেওয়া যাবে। অভিযোগের সঙ্গে পণ্য বা সেবা ক্রয়ের রসিদ সংযুক্ত করতে হবে। শেষে নিজের নাম, পেশা, ঠিকানা, পিতা-মাতার নাম, মোবাইল নম্বর আর ই-মেইল ঠিকানা উল্লেখ করতে হবে। 

অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাসুম আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, আইন অনুযায়ী, উৎপাদনকারী, সেবাদাতা বা বিক্রেতা যে শর্ত দেবে তা অবশ্যই দৃশ্যমান হতে হবে। শুধু শর্ত প্রযোজ্য লিখলে হবে না। সে শর্তগুলো কোথাও থাকতে হবে। ওয়েবসাইট বা অনলাইন লিংক থাকতে পারে। আইন মোতাবেক, যেকোনো বিষয়ে স্পেসিফিক বা নির্দিষ্ট বিষয় উল্লেখ করতে হবে। ক্রেতাকে তাঁর অধিকারের বিষয়টি জানতে দিতে হবে।





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar