ad720-90

হাইব্রিড গাড়ির সুবিধা-অসুবিধা


.ব্যক্তিগত গাড়ি এখন শুধু শখের বিষয় নয়, এর প্রয়োজনীয়তাও কম নয়। ব্যক্তিগত গাড়ি আবার অনেকের রোজগারের উপায়ও বটে। এই গাড়িগুলো ঘুরেফিরে ব্যবহৃত হচ্ছে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবায়। নিজের কাজেও গাড়ি মিলল, আবার বাড়তি উপার্জনও।

এখন নতুন গাড়ি কেনার আগে দুটি প্রশ্ন মাথায় আসে। ব্র্যান্ড নিউ না রিকন্ডিশন্ড? হাইব্রিড নাকি নন-হাইব্রিড? জ্বালানিসাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব হিসেবে সারা পৃথিবীতেই হাইব্রিড জনপ্রিয়। হাইব্রিড গাড়ির সুবিধা এবং অসুবিধা জানাতে আজকের প্রতিবেদন।

হাইব্রিড গাড়ি কী?

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের সমন্বয়ে চালিত যানবাহনগুলো হলো হাইব্রিড গাড়ি। এই গাড়িগুলোতে প্রাথমিক শক্তি হিসেবে ব্যাটারি এবং দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয়। দুই শক্তি গাড়ির প্রয়োজন অনুসারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। পাওয়ার কন্ট্রোল ইউনিট বা পিসিইউ নামের অত্যাধুনিক এক যন্ত্র এই পুরো কাজ করে থাকে। এ জন্য চালককে আলাদা কোনো সুইচ চাপতে হয় না। সাধারণ গাড়িতে জ্বালানি তেলের যে অপচয় হয়, হাইব্রিড গাড়িতে সে অপচয় বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

জ্বালানিসাশ্রয়ী

হাইব্রিড গাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো জ্বালানিসাশ্রয়ী। যখন গাড়ি বিদ্যুৎ-শক্তিতে চলে, তখন ইঞ্জিন বন্ধ থাকে। মোটরে চলার কারণে এই সময় ফুয়েল লাইন বা জ্বালানি তেলের সংযোগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পথ চলতে কোনো তেল খরচ হয় না।

সাধারণ গাড়ি ১ লিটার তেলে যে দূরত্ব অতিক্রম করে, হাইব্রিড গাড়ি স্বভাবতই তার চেয়ে ৭ থেকে ৯ কিলোমিটার রাস্তা বেশি অতিক্রম করে। যানজটের শহরে বেশির ভাগ জ্বালানি গাড়ি বসে থাকাতেই অপচয় হয়। হাইব্রিড গাড়িতে যানজটের সময় ব্যাটারি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। গাড়ি জ্বালানি অপচয়ের হাত থেকে রক্ষা পায়। এ ছাড়া ব্যাটারি চাকার ঘূর্ণনগতি এবং ইঞ্জিনের পরিত্যক্ত কর্মশক্তি থেকে চার্জ সংগ্রহ করে। তাই হাইব্রিড গাড়িতে শক্তির অপচয় হয় না।

পরিবেশবান্ধব

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে প্রতিনিয়ত পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। নগরীতে বাড়ছে দূষণ। গাড়ির কালো ধোঁয়াও এর জন্য দায়ী। হাইব্রিড গাড়ি যখন ব্যাটারি শক্তিতে পরিচালিত হয়, তখন ইঞ্জিন বন্ধ থাকে। গাড়ি থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইডও কম নির্গত হয় হাইব্রিড গাড়িতে। এতে পরিবেশদূষণের হার কমে। দেশে জ্বালানিসাশ্রয়ী হিসেবে হাইব্রিড গাড়ি জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও সারা পৃথিবীতে পরিবেশবান্ধব হিসেবেই এই গাড়িগুলো স্বীকৃত।

যন্ত্রাংশের স্থায়িত্ব বাড়ে

হাইব্রিড গাড়ি ব্যাটারিতে চলার সময় ইঞ্জিন বন্ধ থাকার কারণে ইঞ্জিন অয়েল, অয়েল ফিল্টার এবং এয়ার ফিল্টারও ব্যবহৃত হয় না। এতে এই যন্ত্রাংশগুলোর আয়ু বেড়ে যায়। নন-হাইব্রিড গাড়িতে এই যন্ত্রাংশগুলো তিন হাজার কিমি পরপর বদলাতে হলেও হাইব্রিড গাড়িতে পাঁচ থেকে ছয় হাজার কিমি পর্যন্ত অনায়াসে ব্যবহার করা যায়।

কমবে খরচ

হাইব্রিড গাড়িতে জ্বালানি কম খরচ হওয়ার কারণে তেল কেনার খরচ কমে যায়। জ্বালানির সঙ্গে সম্পর্কিত গাড়ির যেসব যন্ত্রাংশ রয়েছে, সেগুলোও দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়। গাড়িকে তখন আর হাতি মনে হয় না। হাইব্রিড গাড়ি ক্রেতার গাড়িসংক্রান্ত খরচকে কমিয়ে দেয়।

রূপান্তরের ঝামেলা নেই

নন-হাইব্রিড গাড়ির জ্বালানি খরচ বাঁচাতে সিএনজি বা এলপিজিতে রূপান্তর করা হয়ে থাকে। হাইব্রিড গাড়িতে বিকল্প শক্তি হিসেবে ব্যাটারি ব্যবহৃত হওয়াতে এই সব গাড়িকে রূপান্তরের ঝামেলা নেই। নেই লাইনে দাঁড়িয়ে গ্যাস নেওয়ার প্রতিযোগিতা। রূপান্তরের খরচটাও বেঁচে যায়। অটোমোবাইল নির্মাতারা যেভাবে গাড়ি তৈরি করে, সেভাবেই গাড়ি চলাতে ইঞ্জিনও হয় দীর্ঘস্থায়ী।

শুধু বিদ্যুতে চালানোর সুবিধা

হাইব্রিড গাড়িগুলোর মধ্যে একধরনের গাড়ির নাম প্লাগ ইন হাইব্রিড (পিএইচইভি)। এই গাড়িগুলো শুধু ব্যাটারির সাহায্যেই চালানো সম্ভব। পিএইচইভি গাড়িগুলোতে আলাদা করে ব্যাটারি চার্জ করার অপশন দেওয়া থাকে। বাসাবাড়ি থেকেই গাড়িগুলোকে চার্জ করা যায়। পরিপূর্ণ চার্জে পিএইচইভি ঘরানার গাড়ি ৩০ থেকে ৪০ কিমি রাস্তা জ্বালানি খরচ না করেই চলতে পারে।

হাইব্রিড গাড়ির সুবিধা সম্পর্কে মেভেন অটোসের স্বত্বাধিকারী মো. আশফাক বলেন, হাইব্রিড গাড়িতে শুল্ক হ্রাসের পর থেকে এই গাড়িগুলোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। গাড়িগুলোর অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাবে। অনেক জনপ্রিয় নন-হাইব্রিড মডেলের গাড়িগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। অটোমোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও বৈদ্যুতিক এবং হাইব্রিড গাড়ির ওপর জোর দিচ্ছে। তাই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খরচ বাঁচিয়ে হাইব্রিড গাড়ি হতে পারে গ্রাহকের সর্বোত্তম পছন্দ।

কিছু সমস্যার আশঙ্কাও রয়েছে

দক্ষ টেকনিশিয়ানের অভাব

নব্বইয়ের দশকে যখন ম্যানুয়েল গাড়ির বিকল্প হিসেবে স্বয়ংক্রিয় গিয়ার সিস্টেমের গাড়ি আসতে শুরু করল, তখন গাড়ির মিস্ত্রির অভাব দেখা দিয়েছিল। না বুঝে অনেক টেকনিশিয়ান একবাক্যে বলে ফেলেছিলেন, অটো গিয়ারের গাড়ি ভালো না। কিন্তু এখন দেশের ৯৫ শতাংশ গাড়ি স্বয়ংক্রিয় গিয়ার সিস্টেমে পরিচালিত। দেশে অটোমোবাইল নিয়ে পড়াশোনা করে গাড়ির কাজ করেন, এমন প্রকৌশলীর সংখ্যা হাতে গোনা। নতুন প্রযুক্তিতে গাড়ির মিস্ত্রিদের অভ্যস্ত হতে সময়ের প্রয়োজন।

.হাইব্রিড গাড়ি দেশের জন্য নতুন প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে দক্ষ টেকনিশিয়ানও সহজলভ্য নয়। গাড়ি রাস্তায় চললে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে হাইব্রিড গাড়িতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে সব গ্যারেজে সমাধান মিলবে না। চট করে গাড়ির মিস্ত্রি ডেকে সমাধান করে ফেলার চিন্তাটাও এখনো কঠিন।

গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে অজ্ঞতা

হাইব্রিড গাড়ির পেছনের আসনে বাতাস যাওয়ার জন্য এয়ার ভেন্ট থাকে। এয়ার ভেন্ট দিয়ে বাতাস প্রবেশ করে ব্যাটারিকে শীতল রাখে। এতে ব্যাটারি দীর্ঘস্থায়ী হয়। সাধারণত গাড়ি কেনার পর গাড়ির আসনের সিট কভার নতুন করে লাগানো হয়। মাঝেমধ্যে সিট কভার এমনভাবে বানানো হয়, যা এয়ার ভেন্টকে ঢেকে ফেলে। ফলে পেছনের আসনের যাত্রীরা গরম অনুভব করেন। হাইব্রিড গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে না জানার কারণে এই ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সিট কভার তৈরি করা কারিগরেরাও হাইব্রিড গাড়ির এই সিস্টেমের সঙ্গে পরিচিত নন। না জানার কারণে হাইব্রিড গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

চালানোর ধরনের পরিবর্তন

সাধারণত গাড়ি যানজটে দাঁড়িয়ে থাকলে গিয়ার পজিশনকে নিউট্রাল বা ‘এন’-এ রাখা হয়। কিন্তু হাইব্রিড গাড়িতে ‘এন’-এ রাখা বোকামি। হাইব্রিড গাড়ি যানজটে থাকলেও ড্রাইভ বা ‘ডি’তে রেখে হ্যান্ডব্রেক বা ব্রেকহোল্ড ব্যবহার করতে হয়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে পার্কিং বা ‘পি’তে গিয়ার পজিশন রাখতে হবে। ‘ডি’ বা ‘পি’তে থাকলে গাড়ি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যাটারিকে চার্জ করে, যা ‘এন’-এ থাকলে হয় না। হুটহাট এক্সিলারেটরে বেশি গতি তুললে হাইব্রিড সিস্টেম অকার্যকর হয়। এতে ফুয়েল সাশ্রয় কমে যায়। তাই হাইব্রিড গাড়ি চালানোর জন্য নন-হাইব্রিড গাড়ির চালানোর ধরন বদলাতে হবে।

চালকেরা অভ্যস্ত নন

দেশে ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর জন্য ড্রাইভার বা চালক রাখা হয়। চালকেরা নন-হাইব্রিড গাড়ি চালিয়ে অভ্যস্ত। হাইব্রিড গাড়ি চালানোর নিয়মকানুন না জানার কারণে চালকেরা না বুঝে গাড়ির ক্ষতি করেন। হাইব্রিড গাড়ির ড্রাইভিং মোডগুলোও অনেক চালকের নখদর্পণে থাকে না। তাই গাড়ির চালক খুঁজতেও বেগ পেতে হয়।

টায়ার প্রেশারের অজ্ঞতা

গাড়ির চাকায় কী পরিমাণ হাওয়া দিতে হবে, তা প্রতিটি গাড়ির নির্দেশিকা বইতে অথবা গাড়ির চালকের আসনের নিচে স্পষ্ট উল্লেখ থাকে। কিন্তু অধিকাংশ গাড়ির মালিকেরা চাকা বসে না পড়লে অথবা বেশি হাওয়ায় গাড়ি না ঝাঁকানো পর্যন্ত উদ্বিগ্ন হন না। হাইব্রিড গাড়ির ক্ষেত্রে ভালো মাইলেজ পাওয়ার জন্য সর্বদা গাড়ির চাকায় বাতাসের চাপ ঠিকমতো দিতে হবে। কিছু কিছু গাড়িতে টায়ার প্রেশার ইন্ডিকেটর (টিপিএমএস) থাকলেও বেশির ভাগ গাড়িতে এই প্রযুক্তি অনুপস্থিত। চালকেরাও অতটা সচেতন নন। টায়ার প্রেশার ঠিক না থাকার কারণে হাইব্রিড গাড়ির কর্মদক্ষতা হ্রাস পায়।

ব্যাটারি নষ্ট হলে বাড়বে বিপদ

হাইব্রিড গাড়ির প্রাথমিক শক্তি হলো ব্যাটারি। সাধারণত গাড়ির পুরো ব্যাটারি একবারে নষ্ট হয় না। অটোমোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো দুই লাখ কিমি পর্যন্ত ব্যাটারির ওয়ারেন্টি প্রদান করে থাকে। নিকেল মেটাল হাইব্রিড ব্যাটারিতে (এনআইএমএইচ) অনেকগুলো সেল থাকে। দেশে ব্যাটারির সেল সহজলভ্য নয়। তাই প্রতিস্থাপন করার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এ ছাড়া প্রতিটি ব্যাটারির একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। এরপর ব্যাটারি বদলাতে হয়। ব্যাটারির মূল্যও বেশ, যা গাড়ির খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে।

 কুবে মোটরসের কান্ট্রি ম্যানেজার ফাহাদ উল্লাহ বলেন, ‘সারা পৃথিবীতেই জাপানি গাড়ির আলাদা চাহিদা রয়েছে। হাইব্রিড গাড়ি তৈরিতেও জাপানি অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে। দেশের মানুষকে হাইব্রিড গাড়ির ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে আমরা এই ধরনের গাড়িতে বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান করছি। অকশন শিটে ৪ বা তদূর্ধ্ব গ্রেড এবং গাড়ির মাইলেজ ৮০ হাজার কিমির নিচের গাড়িগুলো গ্রাহকেরা নির্দ্বিধায় কিনতে পারেন। হাইব্রিড গাড়ি এখন সময়ের দাবি। যুগের সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষও হাইব্রিড গাড়িতে দ্রুত অভ্যস্ত হবেন বলে আমরা আশাবাদী।’

ব্র্যান্ড নিউ এবং রিকন্ডিশন্ড উভয় ক্যাটাগরিতে হাইব্রিড গাড়ি দেশের বাজারে পাওয়া যায়। ব্র্যান্ড নিউ গাড়ির ক্ষেত্রে বিএমডব্লিউ, টয়োটা, মিতসুবিশি এবং সুজুকির হাইব্রিড গাড়ি রয়েছে। রিকন্ডিশন্ড বাজারে প্রায় প্রতিটি জাপানি অটোমোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে হাইব্রিড গাড়ি পাওয়া যায়। বাংলাদেশে টয়োটা অ্যাকুয়া, এক্সিও, প্রিয়াস, নোয়াহ, আলফার্ড, ভেলফায়ার, এসকোয়ার, কেমরি, সিএইচআর, হোন্ডা ভেজেল, গ্রেস, নিসান এক্সট্রেইলসহ বেশ কয়েকটি মডেলের হাইব্রিড গাড়ি পাওয়া যায়। গাড়ির কোয়ালিটির ওপর নির্ভর করে গাড়িগুলোর মূল্য ১৩ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা হয়ে থাকে।





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar