পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণীটি কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে?
গাছ বলতেই আমরা ফুল বুঝি। অথচ একসময় পৃথিবীতে কোনো ফুল ছিল না। ফুলের জন্ম আজ থেকে ১৩০ কোটি বছর আগে ক্রেটাশিয়াস যুগে। পৃথিবীর জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত যদি এক ঘণ্টা ধরি তাহলে মাত্র ৯০ সেকেন্ড আগে ফুলের জন্ম। যখন পৃথিবীতে অতিকায় ডাইনোসর ঘুরে বেড়াত দাপটের সঙ্গে, তখন তাদের বিশাল পায়ের নিচে ক্ষুদ্র, প্রায় চোখেই পড়ে না এমন এক বিবর্তন ঘটেছিল চোখের আড়ালে। এর আগ পর্যন্ত পৃথিবীতে গাছ বলতে ছিল বিভিন্ন রকমের ফার্ন, কোনিফার। এদের কোনো ফুল ছিল না।
ফসিল থেকে পাওয়া তথ্য বলছে আজ থেকে প্রায় ১৩০ কোটি বছর আগে বর্তমান উত্তর-পূর্ব চীনে প্রথম ফুল ফোটে। এর বৈজ্ঞানিক নাম আর্কেফ্রুকটাস লায়ানিনজেনসিস। ফুলের সঙ্গে এসেছে ফল ও শস্য, যা না হলে পৃথিবীতে আজকের যে প্রাণীদের দেখতে পাই, তাদের বিশাল অংশের জন্ম হতো না। একবিংশ শতাব্দীতে বেঁচে আছে ২ লাখ ৭০ হাজার রকমের ফুল।
ফুলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৃথিবীর প্রাণীদের বিশাল অংশের খাদ্য আর টিকে থাকা। কিন্তু সেই ফুল থেকে ফল–শস্যের জন্মই হতো না যদি ক্ষুদ্র একটা উড়ন্ত পতঙ্গ না থাকে। সেই পতঙ্গের নাম মৌমাছি। এখন পর্যন্ত ১৬ হাজারের বেশি রকমের মৌমাছির খোঁজ পাওয়া গেছে। সাহারা থেকে সাইবেরিয়া যেখানে ফুল ফোটে, সেখানে মৌমাছি আছে। আসলে বলা উচিত, মৌমাছি আছে মানে ফুল আছে, মৌমাছি না থাকলে ফুলই থাকে না। তাদের আকার ২ মিলিমিটার থেকে ২ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। মৌমাছির জন্ম হয়েছে ফুলের সঙ্গে একই সময়ে ক্রেটাশিয়াস যুগে। মধুর জন্য মানুষ মৌমাছি পালন করছে করছে কয়েক হাজার বছর ধরে। প্রাচীন মিসরে এর নজির পাওয়া গেছে।
সায়েন্স টাইমসের মতে, পৃথিবীতে যত রকমের চাষ মানুষ করে থাকে তার ৭০ শতাংশ নির্ভর করে মৌমাছির ওপর। যদি মৌমাছি ফুলে ফুলে উড়ে মধু আহরণ না করে তাহলে তাদের গায়ে ফুলের পরাগরেণু লাগবে না। সেই রেণু অন্য ফুলের গায়ে না লাগলে হবে না পরাগায়ন। খুব কম সময়ের মধ্যে পৃথিবীতে আমাদের চেনা-জানা কোনো গাছের অস্তিত্ব আর থাকবে না। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘মৌমাছি যদি না থাকে তাহলে মানুষ নিশ্চিহ্ন হতে সময় লাগবে চার বছর।’
আরও খবর আছে। ফাউন্ডেশন ফর অ্যাগ্রেরেরিয়ান ইনোভেশনের অর্থায়নে করা এক গবেষণায় জানা গেছে, মৌমাছি একমাত্র প্রাণী, যে কিনা নিজের সঙ্গে কোনো রোগ বহন করে না। ফলে বিভিন্ন ফুলে ঘুরে বেড়ানো মৌমাছি কোনো গাছেই কখনো কোনো রোগ ছড়ায় না।
গত জুলাই মাসে লন্ডনে রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির এক বিতর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘোষণা করা হয় যে মৌমাছি হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জীবিত প্রাণী। এই সিদ্ধান্তের যুক্তি খুব সরল। কোনো প্রাণীর বেঁচে থাকার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি রকমের বেশি সংখ্যার প্রাণীর জীবন নির্ভর করে। মানে কোন প্রাণী না থাকলে সবচেয়ে বেশি প্রাণী আর বাঁচতে পারবে না। এই হিসাবের জায়গা থেকে জিতে গেছে মৌমাছি। এর আগে ২০০৮ সালে আর্থওয়াচের বার্ষিক বিতর্কে এই প্রসঙ্গ উঠেছিল। সেই সময়ও মৌমাছির প্রসঙ্গে আলোচনা গুরুত্ব পায়।
এই তথ্য আমাদের জন্য এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মৌমাছি এখন ঝুঁকিগ্রস্ত প্রজাতির মধ্যে প্রবেশ করছে। হালের গবেষণায় জানা গেছে, গত কয়েক বছরে পৃথিবীর মতো মৌমাছির ৯০ শতাংশ নাটকীয়ভাবে উধাও হয়ে গেছে। ২০১৮ সালে আইইউসিএনের ঝুঁকিগ্রস্ত প্রাণীদের রেড লিস্টে দেখা যাচ্ছে প্রজাপতি, ভ্রমরের মতো পতঙ্গ বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছে।
লাগামহীনভাবে কীটনাশক ব্যবহার, বৃক্ষনিধন, ফুলের অভাব, জলবায়ু পরিবর্তন—এগুলো হচ্ছে মৌমাছির এই আশঙ্কাজনক বিলীন হওয়ার অন্যতম কারণ। সুইজারল্যান্ডের ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি আরেকটা নতুন কারণ প্রস্তাব করেছে। তাদের গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, মোবাইল টেকনোলজিতে ব্যবহার করা তরঙ্গ মৌমাছি বিলীন হওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে। মোবাইলের তরঙ্গ মৌমাছিদের দিক ভুলিয়ে দেয়। আর মৌমাছির দিক ভোলা মানে তার মৃত্যু। ডেনিয়েল ফাভরে নামে প্রাণীতত্ত্ববিদ পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন যে এই রকম তরঙ্গের উপস্থিতিতে মৌমাছি যে সংকেত প্রদান করে তার মানে—বিপদ উপস্থিত, এখনই মৌচাক ছেড়ে পালাতে হবে।
এখন ভাবার সময় এসেছে। যে ডালে বাসা বেঁধেছে মানুষ, সেই ডাল কি সে নিজের হাতে কাটবে? পৃথিবীর আর সব সমস্যার সঙ্গে মৌমাছির মতো ছোট প্রাণীর অস্তিত্ব নির্ভর করছে। কিন্তু মানুষ কি বুঝবে যে এই ক্ষুদ্র মৌমাছির সঙ্গে তার নিজেরও অস্তিত্ব নির্ভর করছে?
Comments
So empty here ... leave a comment!