ad720-90

ফেসবুকে এলাহি কাণ্ড


ফেসবুকে ভুয়া খবরে দৌরাত্ম্য চলছে। ছবি: রয়টার্সকথায় বলে, টাকা দিলে বাঘের দুধ মেলে। ফেসবুক লাইক তো সেখানে কিছুই না। তাই যাঁরা ফেসবুক পোস্টে বেশি লাইক নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন, তাঁদের প্রকৃত বিষয়টি বোঝা উচিত। ফেসবুকে এখন অনেক পোস্টেই প্রচুর লাইক-কমেন্ট দেখা যায়। এসবের অনেক আসলে ভুয়া ও সামান্য অর্থের বিনিময়ে কেনা। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এর প্রমাণ মিলেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেই চিত্র।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে জানানো হয়, সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ফেসবুকে একটি মন্তব্য পোস্ট করেছিলেন ইউরোপের শীর্ষ এন্ট্রিট্রাস্ট্র প্রয়োগকারী ইইউ কমপিটিশন কমিশনার মার্গারেট ভেস্টেগার। তাঁর ওই পোস্টে লাইক পড়ে মাত্র ১৪৪টি। কয়েক মাস পরেই পরীক্ষা করার জন্য গবেষকেরা ওই পোস্টের পেছনে কয়েক ডলার খরচ করেন। এতে দেখা যায়, আধ ঘণ্টায় ওই পোস্টে আরও ১০০ লাইক পড়ে গেছে। ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে একই রকম পরীক্ষা চালিয়ে অর্থের বিনিময়ে লাইক বাড়ার প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকেরা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জাস্টিস কমিশনার ভেরা জোরোভার ক্রিসমাসে করা টুইট নিয়েও একই ফল পাওয়া যায়।

গতকাল শুক্রবার পশ্চিমা সামরিক জোটের সংস্থা ন্যাটো স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশনস সেন্টার ফর এক্সিলেন্স ফেসবুক ও টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের প্ল্যাটফর্ম ঘিরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, এসব প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহার করা সহজ। ফেসবুক ও টুইটার এতে স্বয়ংক্রিয় বট বা প্রোগ্রাম বা অন্যান্য পদ্ধতিতে অপব্যবহার ঠেকানোর যথাযথ পুলিশি ব্যবস্থা বা নজরদারি প্রয়োগ করেনি। সামান্য অর্থের বিনিময়ে যে কেউ কোনো প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া করে অনেক বেশি লাইক, কমেন্ট, ক্লিক বাড়িয়ে নিতে পারে। গবেষণায় এ বিষয়টি প্রমাণিত। 

ন্যাটোর পরামর্শক হিসেবে কাজ করা স্বাধীন ওই প্রতিষ্ঠানটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থের বিনিময়ে প্রভাব খাটানোর বিষয়টি ঠেকাতে সক্ষমতা পরীক্ষা করেছে। তারা মাত্র ৩০০ থেকে ৩৩০ ইউরো খরচ করে ভেস্টেগার, জোরোভার মতো রাজনীতিবিদের পক্ষ স্বল্প সময়ে ৩৫০০ কমেন্ট, ২৫ হাজার লাইক, ২০ হাজার ভিউ ও ৫ হাজার ফলোয়ার কিনতে পেরেছে। তারা ১১টি রাশিয়ান ও ৫টি ইউরোপিয়ান প্রতিষ্ঠানকে এ কাজে লাগায়। এসব প্রতিষ্ঠান ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানে ভুয়া সোশ্যাল মিডিয়া এনগেজমেন্ট বিক্রি করে থাকে।

গবেষণায় দেখা যায়, অর্থের বিনিময়ে যেসব লাইক কেনা হয়, চার সপ্তাহ পরও যেসব লাইক থেকে যায়। যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে ক্লিকগুলো করা হয়, তা সোশ্যাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠানকে জানানোর তিন সপ্তাহ পরেও সক্রিয় থাকতে দেখা যায়।

অনলাইনে ভুয়া খবর ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম অবব্যবহার ঠেকাতে ফেসবুক, ইউটিউব ও টুইটারের লড়াই আরও বেশি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলেই ন্যাটোর এ প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়।

২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকে অনলাইনে ভুয়া খবর ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলে আসছে ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। সম্প্রতি চীন, সৌদি আরব, আফ্রিকার মতো দেশে অনেক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার কথাও বলা হয়েছে। এসব দেশে মূলত রাশিয়া থেকে নতুন কৌশলে ফেসবুক অপব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে।

গবেষকেরা বলছেন, তাঁদের প্রতিবেদনে ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য নতুন করে ভুয়া লাইক বিক্রির প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই রাশিয়াভিত্তিক। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো এখন যেসব পোস্টে এনগেজমেন্ট বেশি থাকে, সেগুলোকে গুরুত্ব দেয় বলে অর্থ খরচ করে এনগেজমেন্ট জমানো পোস্টগুলো বেশি গুরুত্ব পায়। তাই ভুয়া লাইক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কদর বাড়ছে।

গবেষক সেবাস্তিয়ান বে বলেন, ‘আমরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো কীভাবে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তা ভাবি, কিন্তু কীভাবে অপব্যবহার ঠেকানো যাবে, তা নিয়ে চিন্তা করি কম।’

গবেষকেরা বলেন, ইউটিউবে সবচেয়ে বেশি ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি বরা হয়। এসব অ্যাকাউন্ট ভুয়া অ্যাকাউন্ট বাতিল করে কম। এখানে অপব্যবহার করার জন্য খরচও বেশি। ইউটিউব ভুয়া অ্যাকাউন্ট ঘিরে অভিযোগ দিয়েও লাভ হয় না। তারা কোনো অ্যাকাউন্ট মোছে না বা এ বিষয়ে ব্যাখ্যাও দেয় না।

তবে ভুয়া নামে অ্যাকাউন্ট সৃষ্টির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বাধা দেয় ফেসবুক। ফেসবুকে কোনো কনটেন্ট একবার পোস্ট করা হয়ে গেলে তারা সহজে তা মোছে না। ফেসবুক অবশ্য প্রচুর ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরির বিষয়টি স্বীকার করেছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চলতি বছরই ৫৪০ কোটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট ফেসবুক থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। তবে রেকর্ড পরিমাণ ভুয়া অ্যাকাউন্ট ফেসবুক থেকে মুছে ফেলা হলেও এখনো লাখো অ্যাকাউন্ট ফেসবুকে থেকে গেছে। গত বছর ফেসবুক থেকে ৩৩০ কোটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলা হয়েছিল।

ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের প্রায় ২৫০ কোটি অ্যাকাউন্টের মধ্যে ৫ শতাংশ ভুয়া অ্যাকাউন্ট রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলেও এসব ভুয়া অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করা যায়নি। তবে আগের তুলনায় ভুয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার হার বেড়েছে।

সবচেয়ে বেশি ও সহজে অপব্যবহার করার সুযোগ দেয় ফেসবুকের মালিকানাধীন ইনস্টাগ্রাম প্ল্যাটফর্মটি। ফেসবুক ছাড়াও ইনস্টাগ্রামে ভুয়া পোস্ট বাড়ছে বলে জানিয়েছে ফেসবুক। প্রথমবারের মতো ইনস্টাগ্রামকে ট্রান্সপারেন্সি প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত করে ফেসবুক জানিয়েছে, গত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে ৩০ লাখ কনটেন্ট সরিয়েছে তারা।

ফেসবুকের এক বিবৃতিতে বলা হয়, পুরো সোশ্যাল মিডিয়া খাতে ভুয়া এনগেজমেন্ট ঠেকানো চ্যালেঞ্জ হয়ে থেকে গেছে। আমরা ভুয়া এনগেজমেন্ট খোঁজার এবং ভুয়া অ্যাকাউন্ট সরিয়ে ফেলতে বিশাল বিনিয়োগ করেছি।

বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকেরা ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভুয়া খবর ছড়ানো ও ফেসবুকের হস্তক্ষেপের বিষয়ে সমালোচনা করে আসছেন। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের গবেষক সামান্থা ব্র্যাডশ বলেন, ইউরোপিয়ান নির্বাচনের পাশাপাশি ২০২০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও প্রভাব ফেলতে পারে সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহারের বিষয়টি। স্বয়ংক্রিয় বা প্রকৃত অ্যাকাউন্ট থেকে ভুয়া এনগেজমেন্ট তৈরি করে প্রার্থীর জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে একটি ধারণা তৈরি করা হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ঘিরে ভুয়া খবর ছড়ানো ঠেকাতে ফেসবুকের চ্যালেঞ্জের বিষয়টি এখান থেকে বোঝা যায়। ফেসবুক এ ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও ইঙ্গিত দেন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ।

ন্যাটোর প্রতিবেদন প্রসঙ্গে গবেষক ব্র্যাডশ বলেন, অ্যাকাউন্ট না সরানোর কারণ হতে পারে এগুলোর প্রকৃত অ্যাকাউন্ট। এতে প্রতি লাইকদাতা বা শেয়ারদাতাকে সামান্য অর্থ দিয়ে কিনে ফেলা হয়েছে। এটাই মূলত কৌশল এখানে। এসব ক্ষেত্রে প্ল্যাটফর্মগুলোর কিছু করার থাকে না। তবে এ ক্ষেত্রে ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সন্দেহজনক কার্যক্রমের জন্য অ্যাকাউন্ট বাতিলসহ নানা পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করতে পারে।





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar