ad720-90

করোনার ভ্যাকসিন তৈরির প্রযুক্তি মানুষের আয়ত্তে, সময়ের অপেক্ষা মাত্র


প্রতীকী ছবিমুম্বাইয়ের নরিম্যান পয়েন্ট, দাদর বা থানে—কোথাও মাস্ক পরা লোক দেখিনি। মুম্বাই এয়ারপোর্টে চোখে পড়েছিল দু-একজনের। কিন্তু হিথরোতে এসে দেখি মাস্ক পরা লোকের সংখ্যা অনেক।

আমাদের বাড়ি লন্ডনের এক শহরতলিতে। অফিসের কাজে পাঁচ দিন ভারতে ছিলাম। বাড়িতে ফিরে দেখি ১১ বছরের ছেলে ও তার মা দুজনই সন্ত্রস্ত। বক্তব্য একটাই—সুপার মার্কেটে যেতে হবে। অ্যালকোহল সমৃদ্ধ স্যানিটাইজার, প্যারাসিটামল, শুকনো খাবার কিনতে হবে। পাঁচ মিনিট পরপর ফোন আসছে আমার স্ত্রীর কাছে। বন্ধুরা আপডেট দিচ্ছে কোথায় কোনটা পাওয়া যাচ্ছে বা যাচ্ছে না। একের পর এক দেশে/রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি হচ্ছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে বন্ধ করা হচ্ছে স্কুল, কলেজ, সীমিত করা হচ্ছে জনযোগাযোগ। সবাই ভীত। কারণ একটাই—কোনো ভ্যাকসিন নেই।

কবে আসছে ভ্যাকসিন? কত সময় লাগবে? নতুন ওষুধ বানানো ও বাজারে আনা মানে একটা মহাযজ্ঞ। মেধা, সময় আর প্রচুর অর্থের দরকার হয়। সাফল্য থেকে ব্যর্থতাই ঢের বেশি। একটা ওষুধ বাজারে আনতে সময় লাগে প্রায় ১০ বছর। যদি কিনা আমরা ওষুধের আবিষ্কার থেকে প্রাণিদেহে, মানুষে পরীক্ষার সময়টা হিসাবে ধরি। খরচ ৮০ থেকে ১০০ কোটি ডলার। মানুষের শরীরে এক শটি ওষুধের পরীক্ষা হলে মাত্র গড়ে ১৩টি ব্যবহারযোগ্য ওষুধ হিসেবে অনুমোদন পায়। এক শ কোটি ডলার খরচ করার পর ওষুধ কোম্পানিগুলো মাত্র পাঁচ বছর হাতে পায় এই অর্থ তুলে মুনাফা করার।

তা ছাড়া মানবদেহে পরীক্ষার মাঝপথে এসে তা বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কারণ, হয় ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে যে ধারণা করা হয়েছিল সেটির দেখা মেলে না, নতুবা অতিমাত্রাই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। আবার অনেক ক্ষেত্রে অন্য কোম্পানির ওষুধ আগে বাজারে চলে আসার ফলে পরীক্ষা বন্ধ করে দিতে হয়। কারণ, পরীক্ষা সফল হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। পরীক্ষা আপাতদৃষ্টে সফল হলেও বাজারে আগে আসা ওষুধের চেয়ে নতুন ওষুধ অধিক কার্যকরী না হলে মুনাফার আশা নেই।

মানুষের শরীরে পরীক্ষার আগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক বা একাধিক প্রাণীর শরীরে ওষুধটি পরীক্ষা করা হয়। উদ্দেশ্য হলো ওষুধের কার্যকর মাত্রা বা ডোজ ঠিক করা। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা। তারপর প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষা মানব শরীরে। ২০ থেকে ১০০ জন রোগহীন মানুষের শরীরে পরীক্ষা করা হয়। উদ্দেশ্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পুনরায় দেখা এবং নতুন এই ওষুধ সর্বোচ্চ কী পরিমাণে মানব শরীর নিতে পারে তা দেখা। দেখতে হয়, ওষুধের প্রতিক্রিয়া কতটা সময় থাকে মানবশরীরে। ফলাফল আশাব্যঞ্জক হলে পরীক্ষার পরবর্তী ধাপ শুরু হয়। এবার পরীক্ষা করা হয় রোগীদের শরীরে। রোগভেদে রোগীর সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০। সংখ্যা এর বেশিও হতে পারে। রোগ নিরাময়ক্ষমতা দেখা হয় এই ধাপে, সেই সঙ্গে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

শেষ ধাপ বা ফেজ থ্রি। এখানে রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় হাজারে। একাধিক দেশে চালানো হয় এই পরীক্ষা। ফলাফল আশানুরূপ হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে নতুন ওষুধ বাজারজাত করার আবেদন করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই আবেদন প্রথম করা হয় আমেরিকায়। তারপর ইউরোপ, জাপান, চীন ও অস্ট্রেলিয়ায়। আবেদন করা হলেই যে অনুমোদন দেওয়া হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

অনুমোদন পেতে জমা দিতে হাজার হাজার পাতার গবেষণা প্রতিবেদন। শতকোটি ডলার খরচ করা পর ওষুধের দাম নিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হয়। অধিকাংশ ওষুধের খরচ ওঠানো আর মুনাফার জন্য আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান আর চীনের বাজারকে দেখা হয়। পাঁচ বছর পর অধিকাংশ ওষুধ যেকোনো কোম্পানি কপি করতে পারে। জেনেরিক নামে পরিচিত এই ওষুধগুলো দামে আসল ওষুধের চেয়ে অনেক কম হয়।

সংক্রমণজনিত রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার একটু জটিল। শুধু সংক্রমণের সময় ভ্যাকসিনটি পরীক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত রোগী পাওয়া যায় না। ভ্যাকসিন উৎপাদনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো একইভাবে সব ভ্যাকসিন উৎপাদন করা। আগেই যেমনটি বলছিলাম, শতকোটি ডলার খরচ করে একটা ভ্যাকসিন বানানোর পর দেখা গেল কোনো সংক্রমণ হয়নি। এতে খরচের টাকা তোলাটা কঠিন হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় রোগের সংক্রমণ এমন দেশে সেখানে ওষুধের দাম কম রাখাটা খুবই জরুরি।

এই সমস্যাগুলোকে আমলে নিয়ে ২০১৭ সালে বিভিন্ন দেশ এবং বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে অসলোভিত্তিক ‘দ্য কোয়ালিশন ফর প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস’ নামের একটি সংস্থার জন্ম হয়। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, নরওয়ে, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের মতো দেশের সঙ্গে আছে বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন; আছে কিছু ওষুধ কোম্পানি। উদ্দেশ্য সংক্রমণজনিত রোগের ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা।

লক্ষণীয় বিষয়, আমেরিকা এই উদ্যোগের সঙ্গে নেই। ‘দ্য কোয়ালিশন ফর প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস’ নামের সংস্থাটি ইতিমধ্যেই করোনা ভ্যাকসিন তৈরির জন্য দুটি প্রকল্পে অনুদান দিয়েছে। এর বাইরেও চলছে বেশ কয়েকটি কোম্পানির পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এর কয়েকটি প্রায় শেষ পর্যায়ে। ভ্যাকসিন তৈরির পদ্ধতিতে গত কয়েক বছরে অসাধারণ উন্নতি হয়েছে। করোনার ভ্যাকসিন তৈরির প্রযুক্তি মানুষের আয়ত্তে। দরকার শুধু সময়ের। সময়ের হিসাবে কয়েকটা মাস। এ বছরের শেষ নাগাদ দেখা মিলবে ভ্যাকসিনের। তত দিন আতঙ্কিত নয়, সতর্ক থাকতে হবে আমাদের। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মানতে হবে।

সুব্রত বোস: প্রবাসী বাংলাদেশি ও বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়ালস অ্যানালিটিকসের গ্লোবাল প্রধান।
[email protected]





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar