ad720-90

করোনাকালে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া


ছোট একটা স্ক্রিনে আধা যান্ত্রিক গলার স্বর শুনে আমি সন্তুষ্ট হতে পারব না। সারা পৃথিবীর মানুষের মতো আমিও বুভুক্ষের মতো অপেক্ষা করছি কখন আমরা আবার আগের জীবন ফিরে পাব, একটা শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারব এবং সেজন্য বাসায় এসে টানা বিশ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে না!
আমি ধীরে ধীরে খবর পেতে শুরু করেছি যে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়টি নিয়ে ঘরে ঘরে বাবা-মায়েদের ভেতর এক ধরনের দুর্ভাবনা জমা হতে শুরু করেছে। যদি এই বিষয়টা বিচ্ছিন্নভাবে দুই এক জায়গায় হতো তাহলে সেই এলাকার বাবা-মায়েরা দুর্ভাবনা করতে পারতেন। কিন্তু যেহেতু এই করোনা বিপর্যয় শুধু দুয়েক জায়গায় নয়, এমনকি শুধু সারা দেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই হচ্ছে তাই আমি মনে করি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে বাবা-মায়েদের আলাদা ভাবে দুর্ভাবনা করার কোনো কারণ নেই। এই করোনার কালে বাবা-মায়েরা যদি লেখাপড়ার আসল উদ্দেশ্যটা কী সেটা নিয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করেন, আমার মনে হয় তাহলে তাদের দুর্ভাবনাটা আরও
কমে যাবে।

কোনো কিছু জানা বা শেখা লেখাপড়ার আসল উদ্দেশ্য না। লেখাপড়ার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে একজন ছেলে বা মেয়ের ভেতরে জানা কিংবা শেখার ক্ষমতা তৈরি করে দেওয়া। যার ভেতরে জানা বা শেখার ক্ষমতা আছে সে যে কোনো কিছু নিজে নিজে জেনে নিতে পারবে বা শিখে নিতে পারবে।

ঘরবন্দি হয়ে থাকা যেসব বাবা মায়েরা নিজেদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে দুর্ভাবনা করছেন তাদের কাছে আমার একটা মাত্র প্রশ্ন, আপনার ছেলেমেয়েদের কী জানা এবং শেখার ক্ষমতা আছে? নিশ্চয়ই আছে, তাহলে তাদের নিয়ে দুর্ভাবনা করার কোনো কারণ নেই। স্কুল-কলেজ বন্ধ বলে যেটুকু ক্ষতি হয়েছে বা হচ্ছে সেটা পুষিয়ে নেওয়া তাদের জন্য বিন্দুমাত্র কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। এবারে একটু কঠিন প্রশ্ন করি। একটা ছেলে বা মেয়ের জানা বা শেখার ক্ষমতা নেই, এমনটি কি কখনও হতে পারে? মানুষ অন্য প্রাণী থেকে আলাদা তার একটি মাত্র কারণ, তাদের নতুন কিছু জানা বা শেখার ক্ষমতা আছে। কাজেই সব শিশুই কম বেশি জানা এবং শেখার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। ঘরে খুব কম বয়সি শিশু থাকলে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়, আমরা তখন দেখি সেই শিশুটি কী অবিশ্বাস্য কৌতূহল নিয়ে সবকিছু যাচাই করে যাচ্ছে এবং সেটার সামাল দিতে গিয়ে বাবা-মায়েরা কীভাবে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। খুবই একটা দুঃখের ব্যাপার হয় যখন বাবা-মায়েরা ছোট শিশুর কৌতূহল না মিটিয়ে তাকে ধমক দিয়ে শাসন করে তার শেখার আগ্রহটি নষ্ট করে দেন।

স্বপ্ন দেখতে সমস্যা কী? এই দেশের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমি আমার মত করে স্বপ্ন তো দেখতেই পারি!)
এমন কোনো প্রক্রিয়া কি আছে যেটা করে একটা ছেলে বা মেয়ের জানা এবং শেখার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়া যায়? অবশ্যই আছে এবং সেটা হচ্ছে পড়া। একটা শিশু যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করে তখন তার প্রথম কাজটিই হচ্ছে পড়তে শেখা। যে ছেলে বা মেয়ে যত ভালো করে পড়তে শিখে তার শিক্ষাজীবনটি হয় তত সহজ। একটি শিশু যদি তার গুটিকতক পাঠ্যবই ছাড়া আর কিছুই না পড়ে তাহলে তার পড়ার ক্ষমতা বাড়বে কেমন করে?

করোনা কালের এই ঘরবন্দি দুঃসময়টি তাই হচ্ছে বই পড়ার সময়। সেসব ছেলেমেয়েরা হচ্ছে সৌভাগ্যবান যাদের বাসা ভর্তি বই, যারা বই পড়ে শেষ করতে পারছে না। ফেসবুক জাতীয় সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো দিনে দিনে আরও অনেক বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠছে। আমরা বলতে গেলে এখন কোনো মানুষকেই দেখি না যে উদাস মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। আমরা সব সময় দেখি তার হাতে একটা স্মার্টফোন আর সেই স্মার্টফোনের ছোট স্ক্রিনে তার সব মনোযোগ।

যেহেতু শেখার পুরো ব্যাপারটা সব সময় ছাত্রছাত্রীদের নিজেদেরই করতে হয় তাই করোনাভাইরাসের এই গৃহবন্দি সময়ে ছাত্রছাত্রীরা ইচ্ছে করলে নিজেরাই তাদের পাঠ্যবই নিয়ে বসতে পারে। আমি দেখেছি আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোও ধীরে ধীরে যথেষ্ট মানসম্মত হয়ে উঠছে, শুধু তাই নয় নেটে তাদের সব পিডিএফ বই পাওয়া যায়। কাজেই ঘরে বসে বসে নিজে নিজে পড়ার চেষ্টা করা নিশ্চয়ই এমন কিছু বাড়াবাড়ি ঘটনা নয়। আমার বাসায় স্কুল কলেজে যাওয়া কোন ছেলেমেয়ে নেই। যদি থাকত তাহলে আমি কী করতাম? আমি তাহলে তাদের বলতাম, ‘ঘরে বসে বসে পুরো গণিত বইটা শেষ করে ফেলো দেখি!’ তারা যদি চোখ কপালে তুলে বলত, ‘যদি করতে না পারি তাহলে কী করব?’ আমি তাহলে বলতাম, ‘সেগুলো নোট বইয়ে লিখে রাখ। যখন স্কুল খুলবে তখন স্যারকে জিজ্ঞেস করবে!’

করোনার কারনে দেখেছি টেলিভিশনে ছেলেমেয়েদের ক্লাস নেওয়া শুরু হয়েছে। ছেলেমেয়েরা সেগুলো কতটুকু দেখার সুযোগ পাচ্ছে, তাদের কতটুকু লাভ হচ্ছে সেগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা চোখে পড়েনি। কিন্তু চেষ্টা করা হচ্ছে তাতেই আমি খুশি। দুঃসময়ে যেটুকু বাড়তি পাওয়া যায় সেটাই লাভ। ধরে নিতে হবে এটা হচ্ছে একটা বিপর্যয়ের সময়ের জন্য ঠেকা দেওয়া, সবাইকে একটুখানি ব্যস্ত রাখা।

আমি আশা করছি দেখতে দেখতে এই বিপদ কেটে যাবে এবং আবার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠবে। তাদের নাকের ওপর উটকো মুখোশ থাকবে না, পকেটে হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকবে না। অতীতেও পৃথিবী এ রকম বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে এসেছিল, এবারে কেন পারবে না?





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar