ad720-90

মৌমাছি, মৌমাছি কোথা যাও নাচি নাচি …


মৌমাছি ও ফুল। ছবি: লেখক।জাতিসংঘ এদিনটি উৎসর্গ করেছে মধুকর মৌমাছিদের জন্য। মৌমাছিবিশারদ অ্যান্টন জ্যাংজার ২০ মে ১৭৩৪ সালে স্লোভেনিয়ার ব্রেঞ্জিকা গ্রামে জন্মে ছিলেন। মৌমাছিপ্রেমী জ্যাংজারের জন্মদিনে সে গ্রামেই সে দেশের প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে প্রথম মৌমাছি দিবস উদযাপন করা হয়েছিল। সেই থেকে প্রতিবছর ২০ মে বিশ্ব মৌমাছি দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে।

এমন ক্ষুদ্র প্রাণীটির সঙ্গে মানুষের মধুর সম্পর্ক প্রায় আট হাজার বছর অর্থাৎ সেই নব্যপ্রস্তরযুগ থেকে। তখন থেকেই মানুষ মধু এবং মোমের জন্য এই প্রাণীটির ওপর নির্ভর করত। ষোড়শ শতাব্দীর পূর্বে যখন আজকের মতো চিনি সহজলভ্য ছিল না, সেই কালে খাবারদাবার মিষ্টি করতে প্রায় সব ক্ষেত্রেই মধুর ব্যবহার ছিল ব্যাপক। মৌমাছি প্রাণী হিসেবে ক্ষুদ্র হলেও এর ওপর নির্ভর করছে মানুষের টিকে থাকা বা না–থাকা।

আন্তর্জাতিক মৌমাছি দিবসের উদ্দেশ্য হলো, বাস্তুতন্ত্রের জন্য মৌমাছি এবং অন্য যেসব পতঙ্গ পরাগায়নে ভূমিকা রাখছে, সেসব পতঙ্গের অপরিসীম অবদান স্বীকার করা। সেই সঙ্গে এসব প্রাণী যাতে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায়, সে জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।

মৌমাছি এবং এর সঙ্গে আরও কিছু পতঙ্গ পৃথিবীর প্রায় ৮৭টি গুরুত্বপূর্ণ ফসলের পরাগসংযোগে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্নেল বিশ্ববিদ্যালযয়ের সহকারী অধ্যাপক স্কট ম্যাকআর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে এবিসি নিউজ জানিয়েছে, মৌমাছি ও অন্যান্য পতঙ্গ পরাগায়নের মাধ্যমে বিশ্ব জুড়ে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের ফসল উৎপাদনে সরাসরি অবদান রাখছে। মানুষের খাবার জোগানোয় এই ব্যাপক অবদানের জন্যই হয়তো প্রাচীন গ্রিক পুরাণে মৌমাছিকে ‘ঈশ্বরের দূত’ এবং মৌ-রসকে ‘অমৃত’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।

একবার নেকটার (মৌ-রস) এবং পরাগরেণু সংগ্রহে বের হলে একটি মৌমাছি প্রতি সেকেন্ডে ২০০ বার পাখা ঝাঁপটিয়ে ঘুরে আসে ৫০ থেকে ১০০০ ফুল। এক কেজি মধু উৎপাদনে কম করে হলেও ছয় হাজার মৌমাছির বিশাল কর্মযজ্ঞের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া প্রায় দুই সপ্তাহ ৬০ লাখ ফুল থেকে মৌ-রস সংগ্রহ করতে হয়। এ জন্য তাকে চষে বেড়াতে হয় ১ লাখ ৫০ হাজার কিলোমিটার (৯৩ হাজার মাইল), প্রায় ৪ বার পৃথিবী প্রদক্ষিণের সমান পথ।

একটি মৌচাকে ৭০ হাজার মৌমাছি বছরে গড়ে ৩০ কেজি মধু উৎপাদন করে। একটি মৌমাছি জীবনকালে এক চা–চামচের ১২ ভাগের ১ ভাগ মধু উৎপাদন করতে পারে। অর্থাৎ এক চা–চামচ মধুর জন্য ১২টি মৌমাছির সারা জীবন চলে যায়।

মধুর উপকারিতা আমরা কমবেশি সবাই জানি। গলাব্যথা, বদহজম, ত্বকের যত্নে, কাটা-পোড়ায় অণুজীবনাশক হিসাবে মধুর ব্যবহার করা হয়। তবে আজকের আলোচনা যেহেতু মধুকরকে নিয়ে, তাই মধু এখানে অনেকটাই অপ্রসাঙ্গিক। এরপরও যা মনে রাখা প্রয়োজন তা হলো, মধুতে আর্দ্রতা অর্থাৎ পানির পরিমাণ প্রায় ১৭ শতাংশ আর এর ৭৮ থেকে ৮০ শতাংশ হচ্ছে শর্করা বা চিনি। চিনি যাদের এড়িয়ে চলা দরকার, তাদের এ ব্যাপারটি খেয়াল রাখতে হবে। মধুতে অনেক ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে। এ ছাড়া আছে ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান।

ফ্রান্সের খোলাবাজারে একজন মধু বিক্রেতা। ছবি: লেখকবসন্তে যখন গাছে গাছে ফুলের সমারোহ দেখা যায়, মৌমাছি সে সময়টুকুতে প্রচুর পরিশ্রম করে ফুলের মৌ-রস এবং পরাগরেণু সংগ্রহ করতে গিয়ে পরাগায়ন ঘটায় বিশাল সংখ্যক উদ্ভিদে। যার ফলে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে প্রচুর উদ্ভিদ। আর উদ্ভিদের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন। ফলে উদ্ভিদের সুরক্ষায় রক্ষা পাচ্ছে মানুষের এবং আরও অনেক প্রাণীর জীবন। আর এই পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মৌমাছি এমন কাজ করে চলছে প্রায় ১৫ কোটি বছর ধরে।

প্রায় বিশ হাজার প্রজাতির মৌমাছি আছে। তবে অল্প কিছু প্রজাতি মৌ বা মধু সংগ্রহ করে। যখন খাবারের প্রাচুর্য থাকে না, সে সময়ের জন্য আগাম খাবারের মজুত হিসাবেই এরা মধুকোষে (প্রকোষ্ঠে) মজুত করে নিজেদের প্রয়োজনের বেশ কয়েক গুণ বেশি মধু। আর এতে ভাগ বসায় মৌ লোভী মানুষ, ভালুক এবং আরও অনেক প্রাণী।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক জানিয়েছে, গত ১৫ বছর ধরে মৌমাছির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদ সংস্থা এবিসি নিউজ জানিয়েছে, ইতিমধ্যে মৌমাছির সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে। কোনো কোনো অঞ্চলে এমন হ্রাসের হার ৯০ শতাংশ পর্যন্ত দেখা গেছে। শুধু ২০১৯ সালে ২ লাখ কোটি (দুই ট্রিলিয়ন) পোষা মৌমাছি হারিয়ে গেছে। কেন এমন হচ্ছে? এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা প্রথমে দায়ী করেছেন ভারোয়া মাইট নামক একটি ক্ষুদ্র পরজীবীকে। এশিয়ান ও ইউরোপিয়ান মৌ–চাষিদের জন্য ভীষণ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই পরজীবীর আক্রমণ। কেননা এই পরজবীদের আক্রমণ ঠেকাতে এখনো কার্যকরী কোনো উপায় জানা নেই মানুষের। ফলে ব্যাপক হারে মৌমাছির মৃত্যুতে একদিকে যেমন মধু উৎপাদন কমে যাচ্ছে, তেমনি পরাগায়ন ব্যাহত হয়ে ফলনও কমে যাচ্ছে। মৌ–উপনিবেশ ধসে ব্যাধি বা পরজীবীর আক্রমণের সঙ্গে আছে নানা রাসায়নিক (প্রধানত নেওনিকোটিনয়েড) কীট ও আগাছানাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার, খরা, বাসস্থান হারানো, খাদ্যাভাব, দূষণ এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, মৌমাছি ছাড়া মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই মৌমাছির মধু নয়, তার দিকেই আমাদেরকে বেশি খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, বিশ্ব মানবতার প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে এই ছোট্ট সুন্দর ফুলপ্রেমী প্রাণীটির মধ্যে।

লেখক : অণুজীববিজ্ঞানী এবং ফরাসি বিচার বিভাগে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত।





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar