ad720-90

যে বিষয়টির গুরুত্ব খাটো করে দেখবেন না


প্রায় দুই মাস সরকারি ছুটির পর লক ডাউন আপাতত, হয়তো সীমিত সময়ের জন্য, প্রায় উঠিয়ে নেওয়া হলো। এখন অনেকেই ভয় করছেন করোনা আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। অন্যদিকে অফিস, কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য একটানা বেশি দিন বন্ধ রাখাও মুশকিল। তাই এ দুয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্য রেখে অগ্রসর হতে হবে। যেন করোনার বিস্তার যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রেখে অর্থনীতি সচল রাখা যায়। মানুষের আয় উপার্জনের পথ যেন বন্ধ হয়ে না যায়।

করোনা ভাইরাস মূলত ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সংক্রমিত হয়। তাই আমরা মূল জোর দেব বাইরে সব সময় বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরা। সামাজিক দূরত্ব অর্থাৎ আশপাশের মানুষের মধ্যে দূরত্ব অন্তত তিন ফুট রাখা। ছয় ফুট হলে আরও ভালো। বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। এসব তো আমরা করবই। কিন্তু তারপরও হয়তো শর্তগুলো সব সময় মেনে চলা যায় না। যেমন, জন সমাগম এড়িয়ে চলা কঠিন। অফিসে হয়তো খোলা জায়গা কম। কর্মীদের হয়তো কম দূরত্বে বসে কাজ করতে হবে। ২০-৩০ জন কর্মী একটানা সাত-আট ঘণ্টা পাশাপাশি বসে কাজ করলে শ্বাস-প্রশ্বাসের ড্রপলেট ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়াবে। ফলে সংক্রমণের আশঙ্কা কিছু হয়তো থাকবে।

এ অবস্থায় একটি বিষয়ে আমাদের গুরুত্ব বেশি দেওয়া এখন জরুরি। সেটা হলো প্রথমত, নিজ দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও বাড়ানো এবং দ্বিতীয়ত, একই সঙ্গে শ্বাসনালি ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের প্রদাহ (ইনফ্লেমেশন) দূর করা। কীভাবে সেটা করা যায়? এর কিছু কৌশল আছে। মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, ভিড়ের মধ্যে না যাওয়া, এসব তো অবশ্যই করতে হবে। এরপরও দরকার নিজেকে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষার বাড়তি অন্তত এ দুটির ব্যবস্থা করা।

এর উপায় কিন্তু খুব সহজ। প্রথমত নিয়মিত ব্যায়াম। দ্বিতীয়ত ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান সম্প্রতি বলেছেন, বয়স্কদের প্রতিদিন অন্তত আধা ঘণ্টা আর তরুণদের অন্তত এক ঘণ্টা হালকা ব্যায়াম দরকার। অবশ্য বিভিন্ন সময় অন্য স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দিনে ২০-৩০ মিনিটের নিয়মিত ব্যায়ামও ভালো ফল দেয়। বিশেষভাবে বুক ভরে শ্বাস-প্রশ্বাস, হাতের কবজি, পায়ের গোড়ালি, কোমর, ঘাড়সহ দেহের প্রতিটি অস্থিসন্ধি কয়েকবার করে নাড়াচাড়া করা-এগুলোই হলো আসল ব্যায়াম। অফিসে বা ঘরে ডেস্কে বসে কাজ করার সময় মনে রাখতে হবে প্রতি ৩০ মিনিট পর পর চেয়ার ছেড়ে উঠে অফিস ঘরেই অন্তত ৩ মিনিট একটু হেঁটে আসতে হবে।

এর ফলে দেহের পেশিগুলো দৃঢ়তর হয়। এরা মায়োকিনস (myokines) নামক প্রোটিন তৈরি করে। এই প্রোটিন দেহের কোনো অঙ্গ স্ফিতি বা প্রদাহ দূর করতে বিশেষ অবদান রাখে। অন্যদিকে সুসম খাদ্য গ্রহণ করলে শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমে। এটা রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। মাছ-মাংস-ডিম, দুধ, টাটকা ফলমূল, কলা, পেঁপে, সবজি শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে।

এইভাবে আমরা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারি, যা করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই লক ডাউন শিথিল হওয়ার পর আমাদের স্বাস্থ্যবিধির তালিকায় অন্যান্য প্রচলিত করণীয়গুলোর পাশাপাশি প্রতিদিন কিছু ব্যায়াম ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার কথাটিও মনে রাখতে হবে। তাহলে রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা অনেকখানিই কমানো যাবে।

দা নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সায়েন্স টাইমসে গত মঙ্গলবার এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছে।

লক ডাউন শিথিলের বিভিন্ন মডেল

লক ডাউন শিথিল করার বিষয়টি খুব জটিল। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে। যেমন, চীন উপদ্রুত এলাকায় কঠোরভাবে একটানা লকডাউন আরোপ করে রোগ নিয়ন্ত্রণে এনেছে। অন্যদিকে সুইডেনে প্রথম থেকেই কোনো লক ডাউন আরোপ করা হয়নি। এর ফলে সেখানে করোনাভাইরাসের বিস্তারও ঘটেছে তুলনামূলকভাবে বেশি, মৃত্যুও কম হয়নি। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলায় রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হয়েছে। ভিয়েতনাম কোনো রোগাক্রান্ত ব্যক্তির থাকার স্থান ও তার চলাফেরার এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে লকডাউন আরোপ করে রোগ নিয়ন্ত্রণে এনেছে। জাপানও এই পদ্ধতি অনুসরণ করে সফল হয়েছে। তবে ভারত, বাংলাদেশসহ ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশে কিছুদিন লক ডাউন আরোপ করে ধীরে ধীরে শিথিল করা হচ্ছে। সেখানে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয় দেশের কোনো এলাকায় রোগের প্রকোপ খুব বেশি বাড়ছে কি না। সে ক্ষেত্রে এলাকা ভিত্তিক লক ডাউন আরোপ করছে। আমাদের দেশেও সে রকম পদক্ষেপ নিতে হবে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা-এটাই হতে পারে আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য একটি মডেল।

হিসাবে যেন ভুল না হয়

অনেক সময় আমাদের কেউ হয়তো মনে করি, দেশে তো শুধু সড়ক দুর্ঘটনা, ডেঙ্গু, ঘূর্ণিঝড়, যক্ষ্মা প্রভৃতি কারণে প্রতি বছর অনেক মানুষ মৃত্যু বরণ করেন। সে তুলনায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু তো খুব বেশি না। তাহলে ভয় কিসের? কিন্তু এটা ভুল চিন্তা। কোভিড-১৯ মহামারি কিন্তু আরও বেশি ভয়াবহ। এখানে যেন আমরা ভুল চিন্তা না করি এবং শিথিল লক ডাউনের সময়ও যেন পূর্ণ সতর্কতা নিয়ে চলাফেরা করি। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।

প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী গত কয়েক মাসে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৪৩ হাজার, সুস্থ হয়েছেন প্রায় ৯ হাজার এবং মৃত্যু বরণ করেছেন ৫৮২ জন (২৯ মে ২০২০ প্রচারিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব)। এখানে আক্রান্তের তুলনায় সুস্থতার হার প্রায় ২১ শতাংশ এবং মৃত্যুহার মাত্র ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এর বাইরেও হয়তো কিছু মানুষ আক্রান্ত হয়ে আবার সুস্থ হয়ে গেছেন এবং কিছু ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছেন, যা আনুষ্ঠানিক নথিপত্রের হিসাবে আসেনি। প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী আক্রান্ত ও মৃত্যুহার এখনো কম মনে হলেও এটা হয়তো আরও বাড়বে। তারপরও যদি কেউ মনে করেন অন্যান্য রোগ-শোক, দুর্যোগে মৃত্যুর তুলনায় কম, তাহলে ভুল করবেন। কারণ সংখ্যার হিসাবে এটা কম হলেও করোনাভাইরাসে মৃত্যু বেশি ভয়ের। ভুলে যাবেন না, একজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে একই সঙ্গে পরিবারের আরও পাঁচ-ছয়জন আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এইভাবে দেশের মানুষের একটি বড় অংশ কোভিড-১৯ এর শিকারে পরিণত হতে পারেন। এর চেয়ে বড় বিপদ আর কী হতে পারে?

সে জন্যই প্রতি মুহূর্তে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি অক্ষরে অক্ষরে পালন এবং প্রত্যেকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম, মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক
[email protected]

 





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar