ad720-90

কেন চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের মাঝে ‘টিকটক’?


নিরাপত্তা প্রশ্নে নিজ দেশে টিকটক নিষিদ্ধ করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। একই কাজ করতে চাইছে অস্ট্রেলিয়াও। মধ্যখান থেকে অ্যাপটিকে এক হাত নিয়েছে ভারত, নিষিদ্ধ করেছে নিজ দেশে। অথচ টিকটকের সবচেয়ে বড় বাজার-ই ভারত।

কিন্তু কেন এত সমস্যা? সে উত্তরই খোঁজার চেষ্টা করেছে এক বিবিসি প্রতিবেদন। চলুন ওই প্রতিবেদনের আলোকে আমরাও উত্তরটি জানার চেষ্টা করি।

টিকটক আদতে কী?

টিকটককে ইউটিউবের খুদে সংস্করণ বলা চলে। ব্যবহারকারী এক মিনিট দৈর্ঘ্যের ভিডিও পোস্ট করতে পারেন এবং সে ভিডিও’র সঙ্গে জুড়ে দিতে পারেন হরেক রকমের গান ও ফিল্টার। হাস্যরসাত্মক ক্লিপ ও ঠোঁট মেলানোর ভিডিও পর্যন্ত তৈরির সুবিধা দেওয়া হয়।

এক হাজার অনুসারী হওয়ার পর ব্যবহারকারীরা চাইলে ভক্তদের উদ্দেশ্যে লাইভ স্ট্রিম করতে পারেন। চাইলে ভক্তদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে কেনা ভার্চুয়াল উপহারও নিতে পারেন তারা।

চাইলে টিকটক ব্যবহারকারীরা নিজেদের মধ্যে মেসেজ দেওয়া-নেওয়া করতে পারেন।

টিকটকের ব্যাপ্তি

গত বছরের শুরু থেকে প্রায় নিয়মিতভাবেই শীর্ষ ডাউনলোড চার্টে নাম এসেছে টিকটকের। মহামারীর এই লকডাউনে ‘টিকটক’ এবং টিকটকের আরেক সংস্করণ ‘ডোউইন’-এর ব্যবহার অনেক বেড়েছে। সবমিলিয়ে বিশ্বব্যাপী দুইশ’ কোটি বার ডাউনলোড হয়েছে অ্যাপটি, সক্রিয় ব্যবহারকারী রয়েছে প্রায় ৮০ কোটি।

চীনের সঙ্গে টিকটকের সম্পর্ক

আজকের টিকটক মূলত একাধিক ভিন্ন অ্যাপের গল্প। ২০১৪ সালে লঞ্চ হয়েছিল মার্কিন অ্যাপ মিউজিক্যাল ডট এলওয়াই। চীনে ‘ডোউইন’ নামে একই ধরনের সেবা লঞ্চ হয়েছিল ২০১৬ সালে। চীনা প্রযুক্তি জায়ান্ট বাইটড্যান্স লঞ্চ করেছিল সেবাটিকে।

পরে বিশ্বব্যাপী ডোউইনের সেবাকে ‘টিকটক’ নামে ছড়িয়ে দেয় বাইটড্যান্স। টিকটকের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার জন্য ২০১৮ সালে মিউজিক্যাল ডটএলওয়াই-কে কিনে নেয় প্রতিষ্ঠানটি।

সাম্প্রতিক সময়ে এসে নিজেদেরকে টিকটক থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে বাইটড্যান্স। সোশাল ভিডিও অ্যাপটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে সাবেক জ্যৈষ্ঠ ডিজনি নির্বাহী কেভিন মেয়ারকে নিয়োগ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

কতটুকু ডেটা সংগ্রহ করে টিকটক?

টিকটক নিয়ে মূল বিতর্ক ডেটা বা গ্রাহক তথ্য সংগ্রহ নিয়ে। টিকটক ব্যবহারকারীদের বেশ অনেকগুলো তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। এগুলো হচ্ছে,

· কোন ভিডিও দেখছেন গ্রাহক।

· অবস্থান ডেটা।

· ফোন মডেল এবং কোন অপারেটিং সিস্টেমে চলছে ফোনটি।

· মানুষ কোন ছন্দে টাইপ করছেন।

অ্যাপটির এ ধরনের ডেটা সংগ্রহ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। সম্প্রতি ধরা পড়েছে, অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের ক্লিপবোর্ডের ডেটা কপি-পেস্ট করে। এটাও সহজভাবে নিতে পারেননি অনেকে।

তবে, ক্লিপবোর্ডের ডেটা শুধু টিকটক নয়, রেডিট, লিংকডইন, নিউ ইয়র্ক টাইমস নিউজ অ্যাপ, বিবিসি নিউজ অ্যাপসহ আরও অনেক অ্যাপ কপি-পেস্ট করে। অনেকদিক থেকেই টিকটকের ডেটা সংগ্রহকে ফেইসবুকের মতো অন্যান্য সামাজিক নেটওয়ার্কের ডেটা সংগ্রহের সঙ্গে তুলনা করা যায়।

এখন প্রশ্ন হলো একগাদা পশ্চিমা সামাজিক ও সংবাদমাধ্যম অ্য‍াপ যেসব তথ্য সংগ্রহ করে টিকটক সেই একই তথ্য সংগ্রহ করলে সমস্যা কোথায়? জবাব হলো, উল্লিখিত অ্যাপগুলোর মধ্যে একমাত্র টিকটকই চীনা অ্যাপ। আর এক্ষেত্রে চীনা আইন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য।

চীনা আইন বলছে, চীনা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে দেশটির সরকার তার গ্রাহকদের বিষয়ে যে কোনো তথ্য চাইলে তা দিতে বাধ্য থাকবে ওই প্রতিষ্ঠান। আর মার্কিন নাগরিকদের গ্রাহক তথ্য কোনো বিদেশী সরকারের হাতে থাকলে কী হতে পারে তা দেখা গেছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কেলেঙ্কারিতে।

মানুষের উপর নজর রাখতে চীন কী টিকটককে ব্যবহার করতে পারে?

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও অভিযোগ করেছেন টিকটক ব্যবহারকারীরা “চীনা কমিউনিস্ট পার্টির হাতে” ডেটা চলে যাওয়া ঝুঁকিতে রয়েছেন। টিকটক অবশ্য বরাবরই বলে আসছে, চীনের বাইরে সংগৃহীত ডেটা সংরক্ষণ করে থাকে তারা।

চীনের নিয়েন্ত্রণে না থাকার দাবি জানালেও দক্ষিণ কোরিয়ায় শিশুদের ডেটা ভুলভাবে ব্যবস্থাপনা করে জরিমানার মুখে পড়েছিল টিকটক। এ ছাড়াও টিকটকের অ্যালগরিদম ‘অ্যান্টি-সেমিটিক’ মৃত্যুকে সামনে নিয়ে এসেছিল একবার। “আমরা কোনোভাবে চীনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছি এ ধারণাটি পুরোপুরি মিথ্যা”। – বলেছেন টিকটকের ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার জন নীতি প্রধান থিও বারট্রাম।

টিকটককে ঘিরে যে নিরাপত্তা শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে তা অনেকটা হুয়াওয়ের মতোই। মূল শঙ্কাটিই হলো, চীনা সরকার বিদেশী ব্যবহারকারীদের ডেটা হস্তান্তরে টিকটকের মালিক প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্সকে বাধ্য করতে পারে।

দেশটির ২০১৭ সালের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আইন অনুসারে, কোনো সংস্থা বা নাগরিককে “আইন মেনে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা কাজে সমর্থন, সহায়তা, এবং সহযোগিতা করতে হবে”।

অবশ্য ভরসা তৈরির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে বলেছেন,, “চীন সকার ডেটার অনুরোধ নিয়ে এলেও আমরা মানা করে দেবো”।

তবে, বাইটড্যান্স চীনা প্রতিষ্ঠান হয়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে চটাবে কি না বলা মুশকিল। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির জনপ্রিয় সংবাদ অ্যাপ ‘টোটিয়াও’ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অফলাইনে পাঠিয়ে দিয়েছিল বেইজিংয়ের ইন্টারেনেট ইনফরমেশন অফিস। সে সময় সংবাদ অ্যাপটির বিরুদ্ধে “পর্নোগ্রাফিক এবং রুচিহীন কনটেন্ট” প্রচারের অভিযোগ এনেছিল প্রতিষ্ঠানটি।

সরাসরি দেশের শীর্ষ ব্যক্তিদের নির্দেশ অমান্য করলে বড় ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে প্রতিষ্ঠানটিকে। বিবিসি বলছে, এর ফলে প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্বও বদলে যেতে পারে।

চীনা প্রপাগান্ডায় ব্যবহৃত হতে পারে টিকটক?

চীনের ব্যাপারে আরেকটি বড় উদ্বেগ হলো ‘সেন্সরশিপ’। গোটা বিশ্বের মধ্যে রক্ষণশীল ইন্টারনেট ব্যবহারে চীন সবচেয়ে এগিয়ে। বহিঃবিশ্বে সহজলভ্য এবং চীনের জন্য অস্বস্তিকর এমন কনটেন্ট থেকে নিজ নাগরিকদের দূরে রাখতে সর্বদা কাজ করছে দেশটির ‘গ্রেট ফায়ারওয়াল’। ওয়েবের ভিন্ন ভিন্ন অংশ নাগরিকদের জন্য ব্লক করে রাখে ওই ডিজিটাল প্রচীর।

টিকটকেও এ ধরনের সেন্সরশিপের ছায়া দেখা গেছে। গত বছর গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল, তিয়েনআমেন স্কয়ারের প্রতিবাদের ফুটেজ এবং ত্বিতের স্বাধীনতা দাবি সংশ্লিষ্ট কনটেন্ট টিকটকে হয় নিষিদ্ধ হয়, না হলে সীমিত করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি।

ওয়াশিংটন পোস্ট আবার ছয় টিকটক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছিল, কোনো ‘ফ্ল্যাগড’ কনটেন্টের ব্যাপারে সর্বোচ্চ রায় চীনা মডারেটররাই দেয়।

বাইটড্যান্স অবশ্য পরে নীতিমালা পরিবর্তন করেছে বলে জানিয়েছে। তবে, অনেকের এখনও বিশ্বাস, চীনা রাষ্ট্রের পক্ষ নিয়েই টিকটকের ‘মডারেশন’ সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে আপাত নিরীহ দেখতে এই অ্যাপটি।





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar