ad720-90

করোনার চেয়ে বেশি ভয় যক্ষ্মা, এইচআইভি, ম্যালেরিয়ায়


কোভিড-১৯ বৈশ্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার চিত্র বদলে দিয়েছে। বৈশ্বিক এ মহামারির বিস্তৃতিতে উদ্বেগে রয়েছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু করোনার চেয়েও বড় উদ্বেগের কারণ হতে পারে আরেকটি রোগ, যার নাম যক্ষ্মা।

নিউইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ১৫ লাখ মানুষ যক্ষ্মায় মারা যায়। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বিশ্বজুড়ে যে লকডাউন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং সরবরাহ শৃঙ্খলব্যবস্থা যেভাবে ভেঙে পড়েছে, তাতে যক্ষ্মা, এইচআইভি ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগগুলো বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

সাধারণত হালকা জ্বর ও অসুস্থতা দিয়ে যক্ষ্মার উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে। এরপর শ্বাসকষ্ট ও ব্যথাযুক্ত কাশি শুরু হয়। যক্ষ্মা রোগীর আশপাশে থাকা মানুষের মধ্যে ছড়ায় বলে রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খোঁজ রাখা, পৃথক রাখা ও রোগীকে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলেই এ রোগ বিস্তার লাভ করেছে বলে সবচেয়ে সংক্রামক ও হন্তারক হিসেবে এটি পরিচিতি পেয়েছে।

করোনাভাইরাস আসার আগ পর্যন্ত যক্ষ্মার আর দুটি ভয়ংকর বন্ধু হিসেবে ছিল এইচআইভি ও ম্যালেরিয়া। গত এক দশকের মধ্যে ২০১৮ সালে এ দুটি রোগে মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড গড়েছিল। তবে এ বছর করোনাভাইরাস ধাক্কা দিয়েছে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে। ফলে যক্ষ্মা, এইচআইভি ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে অবহেলা দেখানোয় এগুলো বড় হুমকি হয়ে উঠে আসতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক ম্যালেরিয়া কর্মসূচির পরিচালক পেদ্রো এল আলোন্সো বলেন, ‘কোভিড-১৯–এর ঝুঁকি আমাদের সব প্রচেষ্টার গতিপথ বদলে দিয়েছে। দুই দশক আগে আমরা যেখানে ছিলাম, এখন পিছিয়ে সেখানেই গিয়েছি।’

বিশ্বের এক ডজনের বেশি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নিউইয়র্ক টাইমস তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, শুধু করোনাভাইরাসই যক্ষ্মা, এইচআইভি ও ম্যালেরিয়া থেকে বৈজ্ঞানিক মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে না। লকডাউনের কারণে আফ্রিকা, এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকায় এসব রোগ শনাক্ত ও ওষুধ প্রাপ্তিতে বড় সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।

করোনাভাইরাসের ভয়ে অনেক ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক রোগী সেবাবঞ্চিত হয়েছে। এ ছাড়া আকাশপথ ও সমুদ্রপথের বিধিনিষেধের কারণে ওষুধ সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ৮০ শতাংশ যক্ষ্মা, এইচআইভি ও ম্যালেরিয়া কর্মসূচির আওতায় থাকা সেবা বিঘ্নিত হয়েছে। প্রতি চারজনের একজন এইচআইভি রোগী ওষুধ সমস্যায় পড়েছেন। চিকিৎসায় বিলম্ব বা বাধা তৈরি হলে অনেক রোগ ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে পড়ে, যার সমস্যায় ইতিমধ্যে কয়েকটি দেশ ভুগতে শুরু করেছে।

পশ্চিম আফ্রিকায় ইতিমধ্যে ম্যালেরিয়ার মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। বিশ্বের ৯০ শতাংশ ম্যালেরিয়াজনিত মৃত্যু ঘটে সেখানে। কিন্তু সেখানে এ রোগ প্রতিরোধের জন্য সাধারণ ব্যবস্থা হিসেবে কীটনাশক ও মশারির মতো দ্রব্য লকডাউনের কারণে ঠিকমতো পৌঁছাতে পারেনি।

একটি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন অংশে তিন মাসের লকডাউন এবং অন্যান্য কারণে আরও ৬৩ লাখ মানুষ যক্ষ্মা আক্রান্ত হবে এবং ১৪ লাখ মানুষ মারা যাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি যদি ছয় মাস না পায়, তাহলে এইচআইভিতে আরও পাঁচ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে।

কয়েকজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে বলছেন, বর্তমান করোনাভাইরাসজনিত পরিস্থিতি চলমান থাকলে এটি যক্ষ্মা, এইচআইভি ও ম্যালেরিয়ার অগ্রগতি কয়েক বছর এমনকি কয়েক দশক পিছিয়ে দেবে।

করোনাভাইরাস মহামারি শেষ হলেও এর প্রভাব গরিবদের ওপর দীর্ঘদিন থেকে যাবে। দীর্ঘদিন রোগ শনাক্ত না হলে এর চিকিৎসা পেতে দেরি হবে। পরিস্থিতি জটিল হবে। মানুষ বেশি আক্রান্ত হবে এবং মারা যাবে। ম্যালেরিয়া শনাক্তে দেরি হলে তা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। মাত্র ৩৬ ঘণ্টায় জ্বর বেড়ে যেতে পারে। তাই দ্রুত এ ধরনের রোগের চিকিৎসা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো প্রতিষ্ঠান দ্য গ্লোবাল ফান্ডের পূর্বাভাস অনুযায়ী, করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে যক্ষ্মা, এইচআইভি ও ম্যালেরিয়া রোগ প্রতিরোধের অগ্রগতিতে যে ক্ষতি হয়েছে, তা মেটাতে ২ হাজার ৮৫০ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন পড়বে।

স্টপ টিবি পার্টনারশিপ নামের আন্তর্জাতিক এক কনসোর্টিয়ামের প্রধান লুসিকা ডিটিউ বলেন, ‘আপনি যতটা শনাক্তবিহীন ও চিকিৎসাহীন রাখবেন, ততই পরের বছর তা বাড়তে থাকবে। অনেক দেশে এইচআইভি ও যক্ষ্মা শনাক্তের জন্য যেসব অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছিল, তা করোনার চিকিৎসায় দখলে নেওয়া হয়েছে।’

জিনএক্সপার্ট নামের যে টুল দিয়ে টিবি ব্যাকটেরিয়া ও এইচআইভির যে জেনেটিক উপাদান শনাক্ত করা হতো, করোনাভাইরাসের জন্য তার ব্যবহার করা হচ্ছে। যক্ষ্মার চেয়ে করোনাভাইরাসকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি বোকামি। দুটি কাজেই একে ব্যবহার করা যেতে পারে। অনেক দেশ যক্ষ্মা শনাক্তকরণ কমিয়ে দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় কমেছে ৭০ শতাংশ, মোজাম্বিকে ৫০ শতাংশ ও চীনে ২০ শতাংশ যক্ষ্মা শনাক্তকরণ কমেছে।

মেক্সিকোর পরামর্শক গ্রুপ মেডিকেল ইম্প্যাক্টের পরিচালক জর্জিও ফ্রানইয়ুতি বলেন, মেক্সিকোতে কোনো জায়গায় কেউ যক্ষ্মা পরীক্ষা করছে না। চিকিৎসক ও নীতিনির্ধারকেরা আটকে আছেন কোভিড-১৯–এর মধ্যেই। কিন্তু এর মধ্যে বড় দৈত্যটি হচ্ছে যক্ষ্মা। মৃত্যু ও মহামারির হিসাব ধরলে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে কোভিডের তুলনা চলে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব কোম্পানি আগে স্বল্পমূল্যে যক্ষ্মা বা ম্যালেরিয়ার রোগ শনাক্তের যন্ত্রপাতি তৈরি করত, তারা সবাই এখন করোনাভাইরাসের পরীক্ষার আকর্ষণীয় ব্যবসায় নেমেছে। করোনাভাইরাস পরীক্ষায় যেখানে ১০ ডলার আসে, সেখানে মাত্র ১৮ সেন্টের ম্যালেরিয়া টেস্ট করবে কোন প্রতিষ্ঠান?

অনেক দেশে ওষুধ সরবরাহব্যবস্থায় সমস্যায় পড়েছে। ফলে অনেক রোগী তাদের ওষুধ ঠিকমতো পায়নি। এতে স্বাস্থ্যের জন্য ব্যাপক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে অনেক জায়গায় এইচআইভির থেরাপি পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গবেষকেরা বলছেন, এইচআইভি ও যক্ষ্মার মতো রোগে ওষুধ খাওয়া বাদ দিলে রোগী দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ওষুধ প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরি করে ফেলে জীবাণু। ইতিমধ্যে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার জীবাণুর দেখা পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১২১টি দেশে যক্ষ্মা রোগীদের ক্লিনিকে যাওয়া কমে গেছে। অর্থাৎ, দীর্ঘ লড়াইয়ে অর্জিত সাফল্য ম্লান হতে শুরু করেছে। এর পরের আরেক দুশ্চিন্তা আছে যক্ষ্মার ওষুধের স্বল্পতা নিয়ে। ভারতে যেসব ওষুধ তৈরি হয়, সেখানে কর্মী সংকটে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটতে পারে। এ ছাড়া ভারত সরকার নিজেদের ব্যবহারের কথা ভেবে যক্ষ্মার ওষুধ রপ্তানি কমিয়ে দিতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এইচআইভি কর্মসূচির প্রধান মেগ দোহার্টি বলেন, ‘আমরা স্বল্প কিছু ওষুধ উৎপাদনকারীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। এ ব্যবস্থাটি আরও বিস্তৃত হওয়া দরকার। যদি স্থানীয়ভাবে তৈরি ওষুধ ও ওষুধ নির্মাতা থাকে, তবে প্রয়োজনের সময় তা কাজে লাগতে পারে।’





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar