ad720-90

মানুষের পরমায়ু লাভ, না আসবে ফ্রাংকেনস্টাইন?


জিন সম্পাদনার একটি পদ্ধতি হচ্ছে ক্রিসপার-ক্যাসনাইন। এখনো পর্যন্ত তৈরি পদ্ধতিগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে কার্যকর। প্রতীকী ছবিচারটি বর্ণ দিয়ে এই কোড তৈরি। আর তাতেই লুকিয়ে আছে মানবজাতির ইতিবৃত্ত। মানবজীবনের পুরো রহস্য চার বর্ণের তৈরি জিন কোডে আছে। অনেক দিন ধরেই এর অ-আ-ক-খ জানার আগ্রহ মানুষের। বলা হচ্ছে, জিন সম্পাদনায় হাত পাকলেই মানুষ অমরত্বের স্বাদ পেতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে গেছে জিন প্রযুক্তি, ক্রমশ জিন সম্পাদনার নিখুঁত কৌশল বানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এবার কি তবে নীরোগ হবে মানুষ? নাকি তৈরি হবে নতুন ফ্রাংকেনস্টাইন?

২০১২ সালের আগে জিন প্রযুক্তি এতটা সম্ভাবনাময় হতে পারেনি। ওই বছরই আবিষ্কৃত হয় জিন সম্পাদনার নতুন প্রযুক্তি—ক্রিসপার-ক্যাসনাইন। আর তাতেই আমূল বদলে যায় জিন প্রকৌশল। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ক্রিসপার-ক্যাসনাইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিনের নির্দিষ্ট অংশ অত্যন্ত নিখুঁতভাবে কেটে ফেলা যায়। একই সঙ্গে বসিয়ে দেওয়া যায় নতুন কোড। এতে করে ত্রুটিপূর্ণ জিন সরিয়ে একজন মানুষকে এইডস বা ক্যানসারের মতো ভয়ংকর রোগের হাত থেকে বাঁচানো যাবে, বাড়ানো যাবে মানুষের জীবনসীমা। শুধু মানুষ নয়, উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের নানান ক্ষেত্রে জিন সম্পাদনার মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার ক্ষমতা আছে এই ক্রিসপার-ক্যাসনাইন প্রযুক্তির।

বর্তমান জিন প্রযুক্তির সীমা আসলে কতটুকু? ঠিক এই প্রশ্নের নতুন উত্তর দিয়েছেন এক চীনা বিজ্ঞানী। নাম তাঁর হুও জিয়ানকুই। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এক অভিনব ঘোষণা দিয়েছেন সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির এই গবেষক। তিনি বলেছেন, বিশ্বের প্রথম জিন সম্পাদিত মানবশিশুর জন্ম হয়েছে। হুও জিয়ানকুইয়ের দাবি, তাঁর তত্ত্বাবধানেই ওই যমজ শিশুর জিন সম্পাদনা করা হয়েছে। এর ফলে এইডস রোগে আক্রান্ত বাবার এই সন্তানেরা এক বিরল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীর দাবি অনুযায়ী ওই দুই শিশুর দেহে কখনোই এইডস সংক্রমিত হতে পারবে না।

আর এই ঘোষণাতেই সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, উঠেছে বিতর্কের ঝড়। বেশির ভাগ বিজ্ঞানী ও গবেষকই গেল গেল রব তুলেছেন। উঠেছে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন। কারণ মানবদেহে জিন সম্পাদনার প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখনো একমত হতে পারেনি সবাই। নেই কোনো সর্বজনীন নিয়মকানুনও। অর্থাৎ কি করা যাবে আর কি যাবে না—সেই সীমারেখাই টানা হয়নি। সংবাদমাধ্যম সিএনএনের খবরে প্রকাশ, এরই মধ্যে নড়েচড়ে বসেছে চীনের সরকার। বরখাস্ত হয়েছেন হুও জিয়ানকুই। শুরু হয়েছে তাঁর গবেষণা নিয়ে তদন্ত। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সিনহুয়া জানাচ্ছে, হুও জিয়ানকুই প্রচলিত আইন ভেঙেছেন। চীনের সরকারের মন্তব্য, এই গবেষকের কর্মকাণ্ড ‘অত্যন্ত জঘন্য প্রকৃতির’।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান না থাকা সত্ত্বেও জিন সম্পাদনার প্রযুক্তি ব্যবহার করা নৈতিকতার লঙ্ঘন। এতে করে এই প্রযুক্তির অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। অনাকাঙ্ক্ষিত উপায়ে তৈরি হতে পারে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশু। ফলে মানবজাতির মধ্যে সামর্থ্যের দিক থেকে বৈষম্য দেখা দিতে পারে। এমনকি নতুন যুগের ফ্রাংকেনস্টাইন সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

জিন সম্পাদনা কী?
জিন সম্পাদনা তুলনামূলক নতুন প্রযুক্তি। জিন কোড তৈরি হয় অ্যাডিনিন, গুয়ানিন, থাইমিন ও সাইটোসিন—এই চারটি ভিত্তি উপাদান দিয়ে। এই চার উপাদানের আদ্যক্ষরই হলো চারটি বর্ণ। এগুলো দিয়েই তৈরি হয় জিন কোড।

সংবাদমাধ্যম আরটি বলছে, ডিএনএ বা ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড নিয়ে কাজ করে জিন সম্পাদনার প্রযুক্তি। এই প্রক্রিয়ায় ত্রুটিপূর্ণ জিন সংশোধন করা হয় বা নতুন যোগ করা হয়। ক্যানসার, এইডস বা বিভিন্ন বংশগত রোগে ভোগা শিশুদের চিকিৎসায় এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।

চীনা বিজ্ঞানী হুও জিয়ানকুই। তাঁর দাবি, বিশ্বের প্রথম জিন সম্পাদিত মানবশিশুর জন্ম হয়েছে। মানবভ্রূণেই জিন সম্পাদনার কাজটি করেছেন তিনি। ছবি: রয়টার্সজিন সম্পাদনার একটি পদ্ধতি হচ্ছে ক্রিসপার-ক্যাসনাইন। এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে কার্যকর। এ পদ্ধতিতে মানুষের জিনোমের অপ্রয়োজনীয় অংশ ছেঁটে ফেলা হয়। একটি সম্পূর্ণ জিন সেটকে বলা হয় জিনোম। আর জিনোমে থাকে কোটি কোটি ‘রাসায়নিক ভিত্তি’ (কেমিকেল বেস)।

ক্রিসপার-ক্যাসনাইন পদ্ধতি ব্যবহার করে কোনো জীবের জিন কোডের নির্দিষ্ট অঞ্চল চিহ্নিত এবং সেটিকে বিকল করা যায়। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এভাবে কোনো নির্দিষ্ট রোগ সৃষ্টিকারী জিন ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব। ফলে ওই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আর থাকে না।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের অক্টোবরে মানুষের জিন সম্পাদনার নতুন দুটি কৌশল আবিষ্কার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা। নতুন এ দুই পদ্ধতিকে বলা হচ্ছে জিনের ‘আণবিক সম্পাদনা’ প্রযুক্তি। ক্রিসপার-ক্যাসনাইন থেকেই তৈরি হয়েছে নতুন দুটি কৌশল। একটি কৌশল ডিএনএ-তে কাজ করে। অন্যদিকে দ্বিতীয় কৌশলটি কাজ করে রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা আরএনএ-তে। এতে করে আরএনএ সম্পাদনা করা যাবে। এই দুটি কৌশল ব্যবহার করে কোটি কোটি ডিএনএ ‘রাসায়নিক ভিত্তির’ ত্রুটি সংশোধন করা সম্ভব। বিজ্ঞানীদের দাবি, নতুন কৌশলে নিখুঁতভাবে জিন সম্পাদনার মাধ্যমে চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি মানুষের এমন বংশগত রোগের বেশির ভাগের সমাধান করা সম্ভব হবে।

জিন সম্পাদনা নিয়ে বিতর্ক কেন?
হুও জিয়ানকুই দাবি করেছেন, মানবভ্রুণেই জিন সম্পাদনের কাজটি করেছেন তিনি। ভ্রূণে জিন সম্পাদনা করলে, তা পরবর্তী প্রজন্মের বংশগতিতে প্রবাহিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ সম্পাদিত জিন এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে উত্তরাধিকার সূত্রে চলে যায়। সাধারণত পরিণত কোষের জিন সম্পাদনা করা হলে, তা এভাবে প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। সে ক্ষেত্রে শুধু একজন নির্দিষ্ট মানুষের ওপর তা প্রভাব ফেলে। কিন্তু ভ্রূণ, শুক্রাণু বা ডিম্বাণুতে জিন সম্পাদনা হলে সেটি সন্তানসন্ততির মধ্যে চলে যায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই গুরুতর বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা ও চিন্তাভাবনার প্রয়োজন। কারণ এটি পুরো মানবপ্রজাতির বিবর্তনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, জিন সম্পাদনার হালের প্রযুক্তিগুলো এতটাই নতুন, যে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিশদ জানাবোঝার দরকার আছে। এখনো এর অসুবিধা কি কি—তা স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। ক্রিসপার-ক্যাসনাইন পদ্ধতিতে খুব সুচারুভাবে জিন সম্পাদনার কাজটি করা যায় ঠিকই, কিন্তু সেটি করতে গিয়ে অন্যান্য জিনকে তা ক্ষতিগ্রস্ত করে কিনা—তা পরিষ্কার নয়। ফলে এমনও হতে পারে যে, একটি জিন সম্পাদনার পর এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অন্যান্য জিনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। হয়তো জিন সম্পাদনার পর একটি রোগকে প্রতিরোধ করা মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে, কিন্তু অন্যান্য সাধারণ রোগ প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।

নিউ ইয়র্কারে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, এর আগে কখনোই মানবভ্রূণে জিন সম্পাদনার কাজ করা হয়নি। এ সংক্রান্ত গবেষণা এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে। কারণ এর পূর্ণ ফলাফল সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়নি। যখন একটি মানবভ্রূণে জিন সম্পাদনার কাজটি করা হবে, তখন এর ফলাফল সম্পর্কে পুরোপুরি জেনেই করা উচিত। তা না হলে এটি হবে পুরোপুরি অনৈতিক। এর সঙ্গে আবার আছে মানবপ্রজাতির ডিএনএ পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার গুরুতর ঝুঁকি।

ক্রিসপার-ক্যাসনাইন পদ্ধতি ব্যবহার করে কোনো জীবের জিন কোডের নির্দিষ্ট অঞ্চল চিহ্নিত এবং সেটিকে বিকল করা যায়। প্রতীকী ছবি
সম্ভাবনা নাকি বিপর্যয়?

এক্সম্যান সিরিজের ছবিগুলোর কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। সেখানে মিউটেশনের কারণে সাধারণ মানুষই অতিমানবীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে এক্সম্যানে পরিণত হয়। রুপালি পর্দার এই এক্সম্যানেরা আবির্ভূত হতে পারে এই বাস্তব পৃথিবীতেও। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, ‘ডিজাইনার বেবি’ তৈরিতে জিন সম্পাদনা ব্যবহার হতে পারে। আবার ব্যয়বহুল জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে থাকার সম্ভাবনা কম। ফলে এই প্রযুক্তি শুধু ধনীদের কুক্ষিগত হয়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে। তখন দেখা যাবে, শুধু ধনকুবেরদের সন্তানেরাই হবে অসাধারণ।

কিংবদন্তি বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন, জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি এই শতাব্দীতেই সৃষ্টি করতে পারে ‘সুপার হিউম্যান’ তৈরির প্রতিযোগিতা। সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোও কি আর বসে থাকবে? হয়তো প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবেই তৈরি করা হবে নতুন ফ্রাংকেনস্টাইন! সেই দিনটি যেন না আসে—শুভবুদ্ধির বিজ্ঞানীদের আশা এটুকুই।





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar