ad720-90

স্মার্টফোনের বাজার কোন পথে?


বিশ্বজুড়েই ২০১৮ সালে অনেক মানুষ অ্যাপলের দামি আইফোনের দিকে খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি। তাই খুব বেশি সাড়া জাগাতে পারেনি গত বছরের শেষ প্রান্তিকে বাজারে আসা আইফোনের নতুন তিনটি মডেল। ছবি: সংগৃহীত।গত বছর থেকেই বেশ উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান অ্যাপলকে। গত গ্রীষ্মের সময় অ্যাপল প্রথমবারের মতো কোনো পশ্চিমা কোম্পানি হিসেবে এক ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি হয়ে ওঠে। তবে ওই অবস্থানে বেশি দিন টিকতে পারেনি। গত বছরের নভেম্বর মাসে আবার এক ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানির মাইলফলক স্পর্শ করে অ্যাপল। তবে এরপর থেকে আবার অন্য পথে হাঁটতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিম কুক গত এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো আইফোনের চাহিদা কমার পূর্বাভাস দেন। ওই খবরে অ্যাপলের শেয়ারের দাম ১০ শতাংশ কমে আসে। একই সঙ্গে বিশ্বের ঊর্ধ্বমুখী স্মার্টফোন বাজারে পতনের পথও দেখা যায়।

অ্যাপলের দুর্দশার কারণ হিসেবে চীনের অর্থনৈতিক অবস্থাকে দায়ী করেন অ্যাপল প্রধান টিম কুক। দেশটি থেকে মোট বিক্রি হওয়া অ্যাপল পণ্যের ১৮ শতাংশ আয় আসে। বাজার বিশ্লেষকেরা বৈশ্বিক অর্থনীতির ধীরগতি, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ প্রভৃতি কারণে মানুষের কেনাকাটার অভ্যাসে পরিবর্তন আসছে কি না, তা খতিয়ে দেখছেন।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, আইফোন বিক্রি কম হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে বলে ধারণা করা হয়। এর মধ্যে দামের পার্থক্য একটি বড় বিষয়। এ ছাড়া স্মার্টফোনের নতুনত্ব বিবেচনা করেন ক্রেতারা।

এখন রাজনীতি থেকে শুরু করে কেনাকাটা—সবকিছুতেই স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়ছে। স্মার্টফোনের মতো জনপ্রিয় পণ্য খুব কম। এক দশকের বেশি সময় ধরে জনপ্রিয় হচ্ছে স্মার্টফোন। তবে কি স্মার্টফোন বিরক্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে?

বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত চার প্রান্তিকে স্মার্টফোন বিক্রি কমেছে। ২০১৮ সাল জুড়েই প্রথমবারের মতো স্মার্টফোন বিক্রি কমতে দেখা গেছে। স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে ২০১৯ সালকেও টালমাটাল মনে করা হচ্ছে। এ বছর স্মার্টফোন বিক্রি আরও কমতে পারে আবার হুট করে বেড়েও যেতে পারে। অ্যাপলের আইফোনের ক্ষেত্রে যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, তার প্রতিফলন পুরো স্মার্টফোন বাজারে পড়তে পারে।

বাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান নিউ স্ট্রিট রিসার্চের গবেষক পিয়েরে ফেরাগু বলেন, প্রযুক্তি বিশ্বে নতুন পণ্যের যেকোনো প্রথম মডেলটি খুব বেশি ভালো হয় না। দ্বিতীয় প্রজন্মের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। এতে দ্রুত পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়। প্রতিষ্ঠান ও প্রকৌশলীরা দ্রুত আগের ফাঁকফোকরগুলো ধরে নিয়ে বাজার দখলের চেষ্টা করতে পারেন।

স্মার্টফোনের বাজারকে অনেকটাই ব্যক্তিগত কম্পিউটার বা পিসির বাজারের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। অবশ্য স্মার্টফোন পিসির চেয়েও বেশি ব্যক্তিগত যন্ত্র। এটি মানুষের খুব কাছে চলে এসেছে। সাধারণত ২০১১ সাল থেকেই পিসির বাজার বড় হতে দেখা যায়। ওই সময় মানুষ পিসির দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছিল। এরপর থেকে পিসির বাজার কমতে দেখা গেছে। কারণ, পিসির রিসাইকেল টাইম বেড়ে গেছে। তবে গত কয়েক বছরে স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটেছে। এখন ক্রেতারা স্মার্টফোন হালনাগাদ করছেন কম। পুরোনো স্মার্টফোন দীর্ঘদিন ব্যবহার করছেন। একটি স্মার্টফোন তিন বছরের বেশি ব্যবহার করছেন।

বাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান সিসিএস ইনসাইটের মতে, ২০১০ সালে পূর্ব ইউরোপের ক্রেতারা যেখানে একটি স্মার্টফোন ২৬ মাস পর্যন্ত করতেন, তা এখন ৩৯ মাসের আগে পরিবর্তন করছেন না। অর্থাৎ, এখন একটি ফোন দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে, নতুন ফোনে মানুষের আগ্রহ কমতে দেখা যাচ্ছে।

স্মার্টফোনের বাজারে অ্যাপলকে টপকে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে চীনের হুয়াওয়ে। ছবি: সংগৃহীত।বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, আগে নতুন আইফোন বাজারে এলে মানুষ তা কেনার জন্য দোকানের বাইরে তাঁবু খাটিয়ে অপেক্ষা করত। কিন্তু এখন সে আগ্রহ কমে গেছে। অবশ্য নতুন নতুন ফিচারযুক্ত স্মার্টফোন বাজারে আসার পর এখনো কিছুটা আগ্রহ দেখান ক্রেতারা। কিন্তু আগের সেই আগ্রহ নেই। এর বাইরে বাজারে হোম অ্যাসিস্ট্যান্ট বা নতুন ধরনের যন্ত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্যানুযায়ী, অ্যাপলের হাত ধরেই যাত্রা শুরু হয়েছিল স্মার্টফোনের। অ্যাপলের ব্যবসা পরিকল্পনা অন্যদের চেয়ে আলাদা। তারা কমদামি ফোনের দিকে যেতে নারাজ। গত বছরেও সবচেয়ে বেশি দামের আইফোন বাজারে ছেড়েছে। অ্যাপল পণ্যের ক্রেতাশ্রেণিকে ভিন্নভাবে দেখে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু বেশি দামের স্মার্টফোন বিক্রির করার যে ব্যবসা পরিকল্পনা নিয়ে অ্যাপল এগিয়ে যাচ্ছে, তা ধাক্কা খেয়েছে। এখন অনেক সাশ্রয়ী দামে উইন্ডোজচালিত পিসি যেমন বাজার দখল করেছে, তেমনি অ্যান্ড্রয়েডচালিত স্মার্টফোনে ঝুঁকছেন ক্রেতারা। চীনা স্মার্টফোন নির্মাতা হুয়াওয়ে ও শাওমি অ্যাপলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। গত কয়েক প্রান্তিকে অ্যাপলকে টপকে গেছে হুয়াওয়ে।

বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, অ্যাপলের তৈরি স্মার্টফোনের দামের কারণেই সবার কাছে এটি পৌঁছাতে পারেনি বা সর্বজনীন ফোন হতে পারেনি। বিশ্বের করে ধনী দেশগুলোর বাইরে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে আইফোনের দাম। স্মার্টফোন যেহেতু ব্যক্তিগত যন্ত্র বা সহকারীর পর্যায়ে চলে এসেছে, তাই অনেকেই যেকোনোভাবে একটি স্মার্টফোন কাছে রাখছে।

জিএসএমএ ইনটেলিজেন্সের বিশ্লেষক টিম হ্যাট বলেন, স্মার্টফোন ক্রেতারা অনেক বেশি অনুগত। অ্যাপল তাদের আইফোন বিক্রির পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনে বেশি দামের ডিভাইস বাজারে আনার পরেও তা জনপ্রিয় হয়েছে। গত বছরে বাজারে আনা ১ হাজার ৯৯ মার্কিন ডলার দামের আইফোন এক্সএস ম্যাক্স আগের বছরের এক্সএস মডেলের চেয়ে বিক্রি হয়েছে। তবে অ্যাপল যেহেতু হার্ডওয়্যার থেকে বেশি লাভ করে, তাই তাদের ডিভাইস বিক্রি কমলে আয়ে বড় প্রভাব পড়বে।

২০১৮ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে অ্যাপল যে ৬ হাজার ৩০০ কোটি ডলার মুনাফা করেছিল, তা ৫৯ শতাংশ এসেছিল আইফোন বিক্রি থেকে। ১৬ শতাংশ এসেছিল আইফোনসংক্রান্ত সেবা থেকে। ২০২০ সাল নাগাদ এখাতে দ্বিগুণ আয় করতে চান টিম কুক। অ্যাপল এখন আয়ের খাত বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।

স্মার্টফোনের বাজারে অভিনব ফিচারযুক্ত স্মার্টফোন এনেছে ভিভো। চীনা স্মার্টফোন নির্মাতারা দ্রুত উঠে আসছে। ছবি: সংগৃহীত।অ্যাপল শুধু আইফোনের ওপর নির্ভরশীল থাকতে চাইছে না; নতুন যন্ত্রের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ইতিমধ্যে হোম অ্যাসিস্ট্যান্ট বাজারে এসেছে অ্যাপল। এ ছাড়া অ্যাপল ওয়াচ রয়েছে। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যানালিসের বিশ্লেষকেরা বলছেন, অ্যাপলের প্রতিটি পণ্য অত্যন্ত লাভজনক। ইতিমধ্যে স্মার্টওয়াচের বাজারের শীর্ষস্থান দখল করেছে অ্যাপল। এর বাইরে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পণ্যের বাজারেও এগিয়ে আসছে তারা।

অ্যাপল যখন তাদের পণ্যের দাম বাড়ানো নিয়ে ব্যস্ত, তখন এর বিপরীতে অন্য ঘটনাও ঘটছে। বৈশ্বিক স্মার্টফোন বাজারের ৮৫ শতাংশ অ্যান্ড্রয়েড দখল করেছে। বিভিন্ন স্মার্টফোন নির্মাতা বাজারে বিভিন্ন ধরনের গ্রাহক ধরার চেষ্টা করছে। বাজারে ১০০ ডলার থেকে ১ হাজার ডলারের ফ্ল্যাগশিপ ফোন এসেছে। স্মার্টফোন নির্মাতাদের মধ্যে শুরু হয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা। স্মার্টফোন বিক্রি কমে যাওয়ার এ প্রতিযোগিতা টিকে থাকার লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে। এ ছাড়া উপহার দিতে হচ্ছে তাদের। দ্রুত কমছে স্মার্টফোনের দাম।

চীনা স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বে যত স্মার্টফোন বিক্রি হয়েছে, তার অর্ধেকই চীনা স্মার্টফোন নির্মাতাদের। স্মার্টফোন বাজারের শীর্ষে থাকা দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন বিক্রি কমেছে। তবে বাজার দখলে এগিয়ে আসছে চীনের হুয়াওয়ে। গত বছরে ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। হুয়াওয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে শাওমি, অপো, ভিভো। ইতিমধ্যে ভারতের বাজার দখল করেছে শাওমি।

স্মার্টফোনের এ তীব্র প্রতিযোগিতা বাজারে নকিয়া ও সনির মতো প্রতিষ্ঠানকে তীব্র চাপে ফেলেছে। তাদের স্যামসাং বা চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো বড় আকারের বাজার দখল নেই। প্রতিযোগিতা আরও বাড়লে নকিয়া ও সনির মতো ব্র্যান্ডগুলো বাজার থেকে হারিয়ে যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, স্মার্টফোন বিক্রি কমতে থাকলে বাজার কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? বিশ্লেষকেরা স্মার্টফোন বাজার নিয়ে অবশ্য আশার কথা বলছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, স্মার্টফোনে নতুন উদ্ভাবন ঘটছে। এর ফলে আবার বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। এ বছর ভাঁজ করা ফোন আনতে পারে স্যামসাং। এতে স্মার্টফোন ও ট্যাবের ফিচার থাকবে। এ ছাড়া ফোনে ফাইভজি নেটওয়ার্ক–সমর্থিত ফোন এ বছর বাজারে আসতে পারে। সব মিলিয়ে স্মার্টফোনের বাজারে বড় পরিবর্তন ঘটতে পারে। তবে ফোনের দাম যদি বেশি হয় বা ক্রেতার সীমার মধ্যে না থাকে, তবে গ্রাহক মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে।

স্মার্টফোনে নতুন উদ্ভাবন ও ফিচার যদি ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন কী হবে? বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, এতেও স্মার্টফোন নির্মাতাদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ, স্মার্টফোনের ব্যবহারের হার এখনো যথেষ্ট ভালো। আগামী সাত বছরে আরও ১০০ কোটির বেশি মানুষ ইন্টারনেট সুবিধার আওতায় আসবে। এখন অনেকেই সাশ্রয়ী অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করছে। এসব ফোন ৫০ ডলারের কম দামে পাওয়া যায়। এসব ফোনে তাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। তারা স্মার্টফোন পরিবর্তনের কথা ভাববে। এর বাইরে প্রতি তিন মাসে ৩৫ দশমিক ৫ কোটি ফোন বিক্রি হচ্ছে। এত বড় স্মার্টফোনের বাজারে মুনাফা বাড়ানোর আরও অনেক সুযোগ থাকছে।





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar