ad720-90

দুনিয়া কাঁপানো ‘লাভ বাগ’ প্রোগ্রামার এখন মোবাইল সারাই করেন


২০ বছর পর ভাইরাসটি বানানোর জন্য দায় স্বীকার করেছেন ফিলিপিনো নির্মাতা ওনেল ডি গুজম্যান। ৪৪ বছর বয়সী গুজম্যান বিবিসি প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন, পাসওয়ার্ড চুরি করে যাতে বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন সেজন্যই কম্পিউটারে লাভ বাগ ভাইরাসটি ছড়িয়েছিলেন তিনি।

গুজম্যান বলছেন, এটি বিশ্বজুড়ে ছড়ানোর উদ্দেশ্য তার ছিলো না। আর তার কোডের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে সেজন্যও তিনি অনুতপ্ত।

সাইবার অপরাধের ওপর লেখা বই সাইবার ডট কমের জন্য এক সাক্ষাৎকারে গুজম্যান বলেন, “আমার ধারণাই ছিল না যে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে ছড়াবে। আমি অবাক হয়ে গিয়েছি।”

এখন থেকে ঠিক ২০ বছর আগে ২০০০ সালের ৪ মে শুরু হয় লাভ বাগ মহামারী।

এই ভাইরাসের শিকার যারা হয়েছিলেন তারা ইমেইলে একটি অ্যাটাচমেন্ট ফাইল পেয়েছিলেন যার নাম ছিলে- ‘লাভ-লেটার-ফর-ইউ’। আর এই ফাইলে ছিলো ভাইরাসযুক্ত কোড। এই ভাইরাস কম্পিউটারের ফাইল ওভাররাইট এবং পাসওয়ার্ড চুরি করতে পারতো।

ভাইরাসটির সবচেয়ে ক্ষতিকর ক্ষমতা যেটি ছিলো তা হলো, ভুক্তভোগোগীর মাইক্রোসফট আউটলুক অ্যাড্রেস বুকের সব কনটাক্টসের কাছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভাইরাসের একটি কপি চলে যেতো।

উন্মুক্ত হওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে বিশ্বজুড়ে বিশাল সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে ভাইরাসটি। এই সময়ের মধ্যে প্রায় সাড়ে চার কোটি মেশিনকে আক্রান্ত করে লাভ বাগ।

ভাইরাসটি ঠেকাতে অনেক আইটি ব্যবস্থাপক তার কম্পিউটারের সংযোগ খুলে ফেলেছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে।

ধারণা করা হয়, লাভ বাগ ভাইরাসের কারণে কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়েছে।

ওনেল ডি গুজম্যানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় ঘটনার পরপরই।

ওনেল ডি গুজম্যানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় ঘটনার পরপরই।

নিজেদের সুরক্ষায় কয়েক ঘন্টা ইমেইল নেটওয়ার্ক বন্ধ রেখেছিলো যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট। পেন্টাগনও এতে আক্রান্ত হয়েছিল সে সময়।

এর আগের বছরই মেলিসা বাগ নামের আরেকটি ভাইরাসও একই কৌশল ব্যবহার করে কম্পিউটারকে আক্রান্ত করেছে। তবে সে সংখ্যা তুলনামূলক কমই ছিল- কয়েক লাখ।

সে সময় তদন্তকারীরা ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলার একটি অ্যাপার্টমেন্টের নিবন্ধিত ইমেইলের সঙ্গে লাভ বাগ ভাইরাসের সংযুক্তি পেয়েছিলেন।

৫ মে ওই অ্যাপার্টমেন্টে থেকেই আটক করা হয় ওনেল ডি গুজম্যানকে, যিনি শহরের এএমএ কম্পিউটার কলেজের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। গ্রামারসফট নামের একটি আন্ডারগ্রাউন্ড হ্যাকিং গ্রুপের সদস্য ছিলেন তিনি। শীঘ্রই পুলিশের প্রধান সন্দেহভাজনে পরিণত হন তিনি।

সে বছর ১১ মে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন ডি গুজম্যানের আইনজীবি। এতে কিছুটা ইংরেজি বলেন গুজম্যান। ভাইরাসটি দুর্ঘটনাবশত উন্মুক্ত হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে গুজম্যান বলেন, “এমনটা সম্ভব।”

সে সময় কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের জন্য ফিলিপিন্সে কোনো আইন ছিলো না এবং গুজম্যানসহ কাউকেই এজন্য অভিযুক্ত করা হয়নি।

গুজম্যানের সহপাঠী মাইকেল বুয়েনকেও সন্দেহ করা হয়েছিলো। সে সময় অনলাইনে দাবি করা হয়, ভাইরাসটির কোড লেখায় তারও হাত ছিল।

এ ঘটনার পর গায়েব হয়ে যান গুজম্যান। নানা সময়ে অনলাইনের গুজবে এসেছে জার্মানি, অস্ট্রিয়া বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাড়ি দিয়েছেন তিনি। কেউ কেউ দাবি করেছেন লাভবাগ মহামারী ছড়ানোর পর মাইক্রোসফট তাকে নিয়োগ দিয়েছে।

এর অনেক দিন পর ফিলিপিন্স আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটি ফোরামে ২০১৬ সালে এক গ্রাহক দাবি করেন ম্যানিলার কুইয়াপো অঞ্চলে একটি মোবাইল সারানোর দোকান চালাচ্ছেন গুজম্যান।

২০১৯ সালের এপ্রিলে লাভবাগের জনকের খোঁজে ওই এলাকায় অনুসন্ধান চালানোর সিদ্ধন্ত নেন বিবিসি’র প্রযুক্তি প্রতিবেদক জিওফ হোয়াইট।

হোয়াইট ওই এলাকায় গিয়ে দেখেন সেখানে একটি-দুটি নয়, ডজন ডজন দোকানে মাবাইল ফোন সারাই করা হয়। অনেকগুলো দোকানে খুঁজেও তার সন্ধান মেলেনি।

এর পর তিনি ভিন্ন উপায় অনুসরণ করেন। একটি কাগজে গুজম্যানের নাম লিখে বিভিন্ন দোকানের কর্মীদেরকে দেখাতে থাকেন হোয়াইট। এভাবে শেষ পর্যন্ত এক কর্মী বলেন, তিনি গুজম্যানকে চেনেন এবং তার বিশ্বাস গুজম্যান এখন ম্যানিলার অন্য একটি শপিং মলে ফোন সারানোর দোকানে কাজ করেন।

উইন্ডোজ ৯৫ পিসিতে যেভাবে দেখাতো লাভবাগ অ্যাটাচমেন্ট।

উইন্ডোজ ৯৫ পিসিতে যেভাবে দেখাতো লাভবাগ অ্যাটাচমেন্ট।

অন্য শপিং মলটিতেও একইভাবে কাগজে নাম লিখে গলি থেকে গলিতে ঘুরে শেষে একজন একটি দোকান দেখিয়ে দেন। বিল্ডিংয়ের একেবারে শেষ মাথায় স্যাঁতস্যাঁতে এক দোকানে কয়েক ঘন্টা অপেক্ষার পর গুজম্যানের দেখা মেলে।

হ্যাঁ, লাভ বাগ তিনিই তৈরি করেছিলেন, স্বীকার করেন গুজমান। আরও বলেন, স্রেফ ইন্টারনেটে প্রবেশের পাসওয়ার্ড চুরির জন্য আগে একটি ভাইরাস বানিয়েছিলেন। লাভ বাগ ছিল সেটিরই উন্নত সংস্করণ।

ডায়াল-আপ ইন্টারনেটের যুগে অনলাইনে যেতে পাসওয়ার্ড দরকার হতো।  গুজম্যান বলেন তার পকেটে পাসওয়ার্ড কেনার মতো অর্থ ছিলো না।

চ্যাট রুমে যোগাযোগ হয়েছে, প্রাথমিকভাবে এমন ফিলিপিনো গ্রাহকদেরকেই লক্ষ্য বানানোর উদ্দেশ্য ছিলো বলে দাবি করেন গুজম্যান। স্থানীয় ইন্টারনেট অ্যাকসেস পাসওয়ার্ড চুরি করাই ছিলো তার লক্ষ্য।

২০০০ সালের বসন্তে কোডে কিছুটা পরিবর্তন আনেন তিনি। এতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্য গ্রাহকের কাছে ভাইরাসের একটি কপি পাঠানোর ফিচার যোগ করা হয়। মাইক্রোসফটে উইন্ডোজ ৯৫ অপারেটিং সিস্টেমের একটি ত্রুটি কাজে লাগিয়েই আউটলুক গ্রাহকদেরকে ভুক্তভোগী করা হয়। এর পরে যা হয়েছে তা পত্রিকাতেই এসেছে, বিশ্বজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভাইরাসটি।

“আমি বুঝতে পারি, অনেকেই ভালবাসার মানুষ চায়, তারা একে অপরকে চায়, তারা ভালোবাসা চায়, তাই আমি এই নাম দিয়েছি,” বলেন গুজম্যান।

লাভ বাগ জনক আরও বলেন, প্রথমে ভাইরাসটি সিঙ্গাপুরের একজনকে পাঠিয়েছেন তিনি। এরপর তিনি বন্ধুর সঙ্গে পানশালায় চলে যান। নিজের ছড়ানো বৈশ্বিক এই বিশৃঙ্খলা নিয়ে তিনি প্রথম জানতে পারেন যখন তার মা তাকে ফোন দিয়ে বলেন পুলিশ ম্যানিলার এক হ্যাকারকে খুঁজছে।

কিছুদিন গোপনে থাকার পর কম্পিউটারের কাজে ফেরতে আসেন গুজম্যান। তবে, আর কলেজে ফেরত যাওয়া হয়নি। বর্তমানে আরেকজন কর্মীর সঙ্গে মোবাইল সারানোর ছোট একটি দোকান চালাচ্ছেন তিনি।

ভাইরাসটি বানানো এবং এর কারণে যে ক্ষতি হয়েছে তার জন্য অনুতপ্ত হয়ে গুজম্যান বলেন, “কোনো কোনো সময় আমি ইন্টারনেটে আমার ছবি দেখি। আমার বন্ধুরা বলে, ‘এটা কি তুমি!’ আমি লজ্জা পাই। ওই ছবি আমি দেখতে চাই না।”





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar