ad720-90

মে মাসেই করোনা শেষ: আসলেই কি তাই!


সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইনের (এসইউটিডি) ডেটা ড্রিভেন ইনোভেশন ল্যাবের গবেষকেরা সম্প্রতি আভাস দেন, বিশ্বে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মে মাসের মধ্যে শেষ হচ্ছে। বাংলাদেশে এ ভাইরাস ১৯ মের মধ্যে ৯৭ শতাংশ, ৩০ মে মধ্যে ৯৯ শতাংশ বিলীন হয়ে যাবে। এ দাবির যৌক্তিকতা ও বাস্তবতা সম্পর্কে লিখেছেন হার্ভার্ড ও এমআইটির চার শিক্ষার্থী। তাঁদের লেখাটি নিম্নে তুলে ধরা হলো:

গত ২৭ এপ্রিল বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে একটি খবর অনেকেরই চোখে পড়েছে। সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইনের (এসইউটিডি) ডেটা ড্রাইভেন ইনোভেশন ল্যাবের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ ভাইরাসটি ১৯ মের মধ্যে ৯৭ শতাংশ, ৩০ মে মধ্যে ৯৯ শতাংশ বিলীন হয়ে যাবে। (https://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1653247/) সমস্যা হলো, যে গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এই লেখা, তাতে এপিডেমোলজি বা মহামারি-সংক্রান্ত বিদ্যা বা ডেটা সায়েন্স নিয়ে কিছুটা ধারণা থাকলেই বোঝা যায়, এতে গবেষণাটির বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতার অভাব রয়েছে। কয়েক মাস ধরে এমআইটি, হার্ভার্ড, কলাম্বিয়াসহ বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবাসী বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের একটি দলের অংশ হিসেবে সংক্রামক রোগের মডেলিং নিয়ে অনেক কাজ করার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আমাদের কিছু মতামত তুলে ধরতে চাই:

১. সিঙ্গাপুরের এই মডেল পুরোপুরি খেলো। একে বাস্তবতার সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করলে বা এর থেকে নীতিনির্ধারকেরা বাস্তব সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে খারাপ ছাড়া ভালো কিছুই হবে না।

২. সারা বিশ্বে যখন এই মহামারি নিয়ে সবাই ভালো কিছু পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে, তখন এমন গবেষণা কেবল অবৈজ্ঞানিকই নয়, বরং অনৈতিক।

৩. লকডাউনের ফলে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের হার কিছুটা কমলেও এটি পুরোপুরি দূর হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা আসেনি।

সিঙ্গাপুরের সেই গবেষণার কেন পুরোপুরি খেলো? করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রধান উপায় হলো মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলামেশার মাধ্যমে। তাই এই রোগের সংক্রমণে প্রতিটি দেশেই দুটি পর্যায় থাকে। কোনো প্রকার লকডাউন বা কোয়ারেন্টিনের আগে যখন সবাই মুক্তভাবে চলাফেরা করছে, যাতে করোনাভাইরাসও মুক্তভাবে ছড়িয়ে পড়ছে আর লকডাউনের পরে যখন মানুষের চলাফেরা কিছুটা কমে গেছে। ফলে ভাইরাসও ছড়াচ্ছে ধীরে ধীরে। সিঙ্গাপুরের এই মডেলে এই দুটি পর্যায়ের মধ্যে পার্থক্য ধরার কোনো উপায় নেই। একই সমীকরণ দিয়ে তারা দুটি পর্যায় ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছে। স্বাভাবিকভাবেই যদি একই সমীকরণ দিয়ে দুটি পর্যায় ব্যাখ্যা করতে হয়, মনে হতেই পারে করোনাভাইরাস হঠাৎ গতি হারিয়ে নির্জীব হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেটা সত্য নয়, বরং আমরা কেবল পর্যায় ১ থেকে পর্যায় ২–এ প্রবেশ করেছি। লকডাউন আর হোম কোয়ারেন্টিন ছাড়া আমরা আবার শিগগিরই পর্যায় ১ এ ফেরত যাব। সিঙ্গাপুরের এই মডেল এতটাই খেলো যে এই গতির পরিবর্তনের ধারণা সেখানে নেই।

করোনাভাইরাস থেকে একটা দেশের পুরোপুরি মুক্তির উপায় কেবল যখন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এর প্রতি ইমিউন বা অনাক্রম্য হয়ে গেলে। এই অনাক্রম্যতা আসতে পারে কেবল দুই উপায়ে। ১. ভাইরাসে একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে (যেমন চিকেন পক্স), অথবা ২. ভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন গ্রহণ করলে (পোলিও)। বিশ্বের সব দেশেই এখন ভয়টা হলো, যদিও আমরা লকডাউন করে ভাইরাসের গতি কমিয়ে আনতে পেরেছি, অধিকাংশ মানুষ এখনো অনাক্রম্য হয়ে ওঠেনি। তাই যদি এখন লকডাউন খুলে দেওয়া হয়, তাহলে সবচেয়ে বড় বিপদ হলো দ্বিতীয় দফার ধাক্কা।

প্রতি হাজারে মৃত্যুযেমনটা এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ১৯১৮-১৯ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে কিন্তু দ্বিতীয় দফাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল, যা ছিল প্রথমবারের থেকে প্রায় ৫ গুণ বেশি মারাত্মক। হাস্যকরভাবে সিঙ্গাপুরের এই খেলো মডেলে দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ পুরোপুরি অসম্ভব। এমন সব গাণিতিক মডেল নিয়ে গবেষণা করলে আজগুবি আশাজনক ফলই যে পাওয়া যাবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমাদের সামনে যে বিপদ, তা হলো করোনাভাইরাস নির্মূল হওয়ার আগেই, সময়ের আগেই লকডাউন খুলে দেওয়া। যখন দ্বিতীয় দফা শুরু হয়ে যাবে, তা ঠেকানোর উপায় আমাদের হাতে থাকবে না।

এই গবেষণা কেন অনেকটাই অনৈতিক? প্রথমেই আমরা দেখতে পারি সিঙ্গাপুরের সেই গবেষণা যেখানে প্রকাশ হয়েছে তার অবস্থা (গবেষণা ল্যাবের প্রধান ওয়েবসাইট: https://ddi.sutd.edu.sg/when-will-covid-19-end)

গবেষণা ল্যাবের প্রধান ওয়েবসাইটএই ওয়েবসাইট তৈরিই করা হয়েছে শিক্ষা আর গবেষণামূলক উদ্দেশ্যে, আর প্রতিটা দেশের যে বাস্তব অবস্থা, তার সঙ্গে এই মডেল যথাযথভাবে মিলবে না। পাঠকের দায়িত্ব এই ভবিষ্যদ্বাণী যাচাই করে নেওয়া। আর এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে খুব আশাবাদী না হওয়া। এই গবেষকেরা বলেই দিয়েছেন, এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অত্যধিক আশাবাদী হয়ে আমরা যদি কঠোর ব্যবস্থা বন্ধ করে দিই, তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এখন কথা হলো, যেখানে অধিকাংশ পাঠকেরই বিজ্ঞান বা সংক্রামক রোগ নিয়ে খুব বেশি ধারণা নেই, সেখানে কীভাবে আশা করা যায় যে তারা এই গবেষণা পড়ে, সেখান থেকে কেবল শিক্ষা ও গবেষণার তথ্যটুকু নেবে? আর আমাদের অবস্থা এখন হলো ডুবতে বসা মানুষের মতো, খড়কুটো হাতে পেলে সেটাই আঁকড়ে ধরতে রাজি আমরা, সেখানে এমন একটা গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করা হলে সেটা পড়ে মানুষের ভুল বোঝা কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র।

তা ছাড়া গবেষণাটিতে প্রকাশিত গ্রাফগুলো থেকেই দেখা যায় কীভাবে এই মডেলের মাধ্যমে করোনার প্রতিদিনের পরিবর্তনের মাত্রাকে কেবল একটি সমীকরণে বসানোর চেষ্টা করা হয়েছে, যার কোনো বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতা নেই।

গবেষণাটিতে প্রকাশিত গ্রাফগুলো থেকেই দেখা যায়, কীভাবে এই মডেলের মাধ্যমে করোনার প্রতিদিনের পরিবর্তনের মাত্রাকে কেবল একটি সমীকরণে বসানোর চেষ্টা করা হয়েছেবাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা এবং আমাদের করণীয়

কোভিড-১৯ বা যেকোনো সংক্রামক রোগের বিষয়ে পরিস্থিতি বোঝার জন্য আমাদের রোগটি গড়ে একজন থেকে কতজনে ছড়িয়ে যেতে পারে, সেই সংখ্যা বের করতে হয়। এই সংখ্যাকে সংক্রামক রোগতত্ত্বে বলা হয় বেসিক রিপ্রোডাকশন রেট বা R0। বাংলাদেশের জন্য আমাদের গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে যে বাংলাদেশে মার্চের শেষে R0 ছিল ৩ এর কাছাকাছি এবং লকডাউন ও সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের পর এই সংখ্যা কমে ১.১ এর কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু এই সংখ্যা ১ থেকে কমার আগ পর্যন্ত করোনা থেকে আমাদের আশু মুক্তি মিলবে—এই কথা বলার সুযোগ নেই। যখন সংখ্যাটি ১ থেকে কম হবে, তখন আমাদের প্রতিদিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকবে।

সংক্রামক রোগের বিষয়ে পরিস্থিতি বোঝার জন্য রোগটি গড়ে একজন থেকে কতজনে ছড়িয়ে যেতে পারে, সেই সংখ্যা বের করতে হয়।কিন্তু এ মুহূর্তে যদি আমরা সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত না করে লকডাউন তুলে দিই, তাহলে আমরা দ্বিতীয় দফা ধাক্কার সম্মুখীন হতে পারি। যদিও আমাদের ভালো কিছুর আশা করতে দোষ নেই, কিন্তু নীতিনির্ধারক পর্যায়ে এই ধরনের গবেষণা থেকে আত্মপ্রসাদে ভোগার কোনো সুযোগ নেই।

বিশেষত, বাংলাদেশের প্রতি লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে করোনা পরীক্ষার সংখ্যা মাত্র ৩৮.৪, উন্নত বিশ্বে যেখানে সেটি প্রতি লাখে দুই থেকে তিন হাজারের ভেতর। উন্নত বিশ্ব বাদ দিলেও ভারত (লাখে ৬১) বা পাকিস্তানের (লাখে ৭৯.৫) মতো দেশের থেকেও নাজুক অবস্থা এখানে আমাদের। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার ভেতরে মিয়ানমারের পর পরীক্ষায় সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। তাই ভিয়েতনাম বা কোরিয়ার উদাহরণ অনুসরণ করে প্রতিদিন লাখ, লাখ পরীক্ষা এবং আক্রান্ত রোগীদের আলাদা করতে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তার মাধ্যমে যদি প্রমাণ করতে পারি যে প্রকৃতভাবেই আমরা R0 এর মান ১ এর নিচে রাখতে পারছি, তাহলেই কেবল আমরা নিশ্চিত হতে পারব করোনা থেকে মুক্তির বিষয়ে। তা না হলে আমাদের সামনে একটি ভয়ানক পরিস্থিতিই অপেক্ষা করে আছে, যার রুদ্রমূর্তি হয়তো দেখা যাবে মে মাসের পরে।

তারিক আদনান (হার্ভার্ড), নূর মোহাম্মদ শফিউল্লাহ (এমআইটি), আদিব হাসান (এমআইটি) ও সানজিদ আনোয়ার (এমআইটি) যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা ও গবেষণা করছেন। তাঁরা বাংলাদেশ গণিত দলের সাবেক সদস্য।





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar