ad720-90

নেতৃত্বের কোন দিকগুলি বেজোসকে এতোদূর এনেছে?


সেই সময় অ্যামাজন ছিল কয়েকশ’ কোটি ডলারের একটি প্রতিষ্ঠান, আর তারা যাচ্ছিলেন অ্যামাজনের গ্রাহকসেবা কেন্দ্রে। যেখানে তাদের গ্রাহক পরিষেবা এজেন্ট হিসাবে দুই দিন থাকার কথা ছিল।

“জেফ নিজেই ফোন কলের জবাব দিচ্ছিলেন”, ব্রায়ার বলেন। এতোদিন পরেও তার মনে আছে, বিশেষ একটি পণ্যের বিষয়ে অভিযোগ আসছিল। “জেফের চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছিল” তিনি বলেন।

বেজোসকে হতাশা পেয়ে বসছিলো। বোঝাই যাচ্ছিলো, পণ্যটিতে কিছু সমস্যা আছে। সেদিনই পরে তিনি ত্রুটিপূর্ণ পণ্য চিহ্নিত করার আরও কার্যকরী উপায় চেয়ে একটি ইমেল পাঠিয়েছিলেন।

কলিন ব্রায়ারের বলা এই গল্পটি উঠে এসেছে বিবিসির প্রতিবেদনে।

অ্যামাজন প্রতিষ্ঠা করার ঠিক ২৭ বছর পর বেজোস সোমবার অ্যামাজনের নেতৃত্ব ছাড়ছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে নেতৃত্বের অস্বাভাবিক নীতির একটি রেওয়াজ তৈরি করেছেন। অনেকেই বলেন, এগুলোই ছিল তার সাফল্যের মেরুদণ্ড। অন্যরা বিশ্বাস করেন, বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এই সমস্যাগুলো থাকেই।

অ্যামাজনে কখনও কাজ করেছে এমন যে কারো সঙ্গে কথা বলুন। “কাস্টমার অবসেশন” কথাটি শোনার জন্য আপনাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না।

বেজোসের দৃষ্টিকোণ থেকে মুনাফার বিষয়টি হুট করে পাওয়ার মতো কোনো বিষয় ছিল না। সফল প্রতিষ্ঠান হওয়ার জন্য অ্যামাজন চেয়েছিল সন্তুষ্ট গ্রাহক শ্রেণি– যে কোনও মূল্যে।

নাদিয়া শোরাবাউরা ২০০৪ সালে অ্যামাজনে কাজ শুরু করেন। তিনি আমন্ত্রণ পান অ্যামাজন ম্যানেজারদের অভিজাত ‘এস-টিম’ বা সিনিয়র ম্যানেজার বোর্ডে। কিন্তু যখন তিনি কাজ শুরু করলেন, তিনি ভেবেছিলেন খুব শিগগিরই তিনি চাকরিটা খোয়াবেন।

“একেবারে ক্রিসমাসের সময় আমি আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ভুলটি করে বসি।”

ছবি: রয়টার্স

ছবি: রয়টার্স

নাদিয়া গুদামের শেলফে মূল পণ্যগুলি রাখতে বলেন, কিন্তু শেলফগুলো যথেষ্ট উঁচু ছিল। তাক থেকে সঠিক পণ্যগুলি নামাতে সময় এবং অর্থখরচ দুটোই বেশি লাগতো।

“আমি চিন্তাভাবনা করে একটি স্মার্ট উপায় বের করলাম যাতে অর্থ খরচ কম হয়। কিন্তু আমি যখন জেফের সাথে এই বিষয়ে কথা বলেছিলাম তখন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি এই সব নিয়ে ভুল লাইনে ভাবছেন’।”

“আপনি ভাবছেন, কীভাবে এখানে পয়সা খরচ কমানো যায়। সেটা বাদ দিয়ে গ্রাহকদের জন্য সহজ হবে এমনভাবে সমস্যাটি সমাধান করুন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমার কাছে এসে জানিয়ে যাবেন এতে খরচ কতোটা হচ্ছে।”

বম্বশেল দাবি

বেজোসের অনেক সমালোচনা রয়েছে। এরই মধ্যে গত মাসে প্রোপাবলিকা সাময়িকী একটি বোমাফাটানো নিবন্ধে বেজোসের ট্যাক্স রিটার্ন দেখার দাবি করেছে। সেখানে অভিযোগ, জেফ বেজোস ২০০৭ এবং ২০১১ সালে কোনও কর দেননি। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিকে নিয়ে এমন দাবি অবাক করা তো বটেই।

অ্যামাজন সম্পর্কে অন্যান্য নেতিবাচক গল্পের মধ্যে এর দয়ামায়হীন কাজের পরিবেশ, বাজারে একচেটিয়া আচরণের মতো বিষয়গুলো বেজোসের খ্যাতিকে সাহায্য করেনি।

তবে এ-ও সত্যি, যারা তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন তারা মানে করেন না যে তিনি কর্মীদের প্রতি যত্নশীল নন বা স্বার্থপর।

তাদের চোখে বরং তিনি একজন দূরদর্শী ব্যবসায়ী- একক ফোকাসসম্পন্ন মানুষ যিনি তার কিংবদন্তীসম কাজের দর্শন ব্যবহার করে প্রায় ১৮ হাজার কোটি ডলারের প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন।

দুই পিৎজা নিয়ম

বেজোস ছোট দল পছন্দ করেন। মিটিংগুলো যেন কাজের হয় সে জন্য তার একটি নিয়ম রয়েছে– নিশ্চিত করুন যে আপনি মিটিংয়ের সবাইকে স্রেফ দুটি পিৎজা দিয়ে খাওয়াতে পারেন।

তিনি পাওয়ারপয়েন্ট উপস্থাপনা দু’চোখে দেখতে পারেন না। বরং নির্বাহীদের আলোচনার জন্য লিখিত মেমো পছন্দ করেন।

মিটিংয়ে নিজের প্রভাবশালী অবস্থানের প্রভাব এড়াতে তিনি অনেক সময়ই প্রতিজন অংশগ্রহনকারীর কাছে যাবেন, জিজ্ঞাসা করবেন যে তারা আলোচ্য বিষয়টি সম্পর্কে কী ভাবছেন।

এবং যারা তাকে চেনেন তারা বলেন, যারা ভিন্ন যুক্তি দেয়া কর্মীদের তিনি পছন্দ করেন। শোরাবাউরা বলেন, “আমরা তর্ক করতাম এবং আমরা একে অপরের দিকে চিৎকার করতাম।”

“তার সঙ্গে সবকিছু খুব খোলামেলা এবং যে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়। কখনও কখনও তর্ক উত্তপ্ত আর আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। কিন্তু সবসময়ই সেটি ছিল আলোচনার বিষয়টি সম্পর্কে, কখনই ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়।”

অ্যামাজনের ১৪টি ‘নেতৃত্বের নীতি’ রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো, প্রতিষ্ঠানটি “ভিন্নমত পোষণ করার মতো মেরুদণ্ড” থাকার কথা বলে।

ছবি: রয়টার্স

ছবি: রয়টার্স

এবং সম্ভবত বেজোস সত্যিই প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ্যদের স্তরে সেই সংস্কৃতিকে উৎসাহ দিতে চান। নীতিটি বলছে, “সামাজিক সহাবস্থানের প্রশ্নে নেতাদের আপস করা উচিত নয়”।

অবশ্য, আমাজনের নিচের স্তরে সেই দর্শনটি উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস ২০১৫ সালে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে যেখানে সাবেক কর্মচারীরা আঘাতপ্রবণ কর্ম সংস্কৃতির কথা বলেছেন।

বেজোস কৌশল, আবিষ্কার, মেশিনের ভক্ত। তিনি আচ্ছন্ন মেট্রিক্স নিয়ে। হ্যা, লজিস্টিক জগতে একটি খারাপ বৈশিষ্ট্য নয়। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, তার এই আচ্ছন্নতার পেছনে মানুষের কষ্ট, অনুভূতি যে আবেগের বিষয় আছে, যেটাকে বলা হয় হিউম্যান কস্ট, বিশেষ করে অ্যামাজনের অসংখ্য গুদামে।

আলাবামার বেসেমারে আমাজন কর্মীদের একটি ইউনিয়ন গঠনের ব্যর্থ প্রচেষ্টার সময় শ্রমিকরা বলেছেন তারা নিজেদের “মেশিনের মতো” অনুভব করেন। অন্যরা “ক্রমাগত নজরদারিতে থাকার” অনুভূতির বর্ণনা দিয়েছেন।

তবে, এর ওপরের স্তরে বেজোসের ব্যবস্থাপনা শৈলী ভিন্ন। সেখানে তিনি দলগুলোর জন্য স্বায়ত্তশাসন পছন্দ করেন, যা উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে বলে তার বিশ্বাস।

অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস (এডাব্লিউএস), বিস্ময়করভাবে সফল ক্লাউড কম্পিউটিং পরিষেবা, অ্যামাজনের মূল ব্যবসা ই-কমার্সের সঙ্গে এর খুব বেশি সম্পর্ক ছিল না।

তবে বেজোস এডাব্লিউএস-এর ধারণাটি পছন্দ করেছিলেন। বিশ্বস্ত কর্মী অ্যান্ডি জেসিকে একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই আরেকটি প্রতিষ্ঠান তৈরির স্বাধীনতা এবং মূলধন দিয়েছিলেন। বেজোস মনে করেন, জেসি একজন উদ্যোক্তা, স্রেফ একজন ম্যানেজার নয়। আর সে কারণেই তিনি বেজোসের উত্তরসূরি হিসাবে দায়িত্ব নিচ্ছেন।

শোরাবাউরা বলেন, “আপনি যখন স্টার্ট-আপ হন তখন সাহসী হওয়া সহজ।”

“বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহসী হওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ে। কারণ এখন আপনি আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকি নিচ্ছেন। তিনি সবসময় খুব সাহসী ছিলেন।”

যারা তাকে চেনেন তারা বলেন, বেজোস সমস্যাটি বেয়ে এর গোড়ায় যেতে পছন্দ করেন। “এটি অ্যামাজনে একটি খুব নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া” ব্রায়ার বলেন।

পরিকল্পনা পর্যায়েও দলগুলি একটি বিপরীতমুখী সময়রেখা ধরে কাজ করে। আনুষ্ঠানিক শুরু কেমন হবে তা দিয়ে শুরু করে তারপরে ক্রমাগত পেছনের ধাপগুলো কি হবে তা ঠিক করার রেওয়াজ মেনে চলে প্রতিষ্ঠানটি।

“দলটি প্রথম যে কাজটি করে তা হলো, একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি লেখে। যে কাজটি সাধারণত অন্য প্রতিষ্ঠানগুলি সবার শেষে করে।”

এটি সময় সম্পর্কে বেজোসের দৃষ্টিভঙ্গিতেও দেখা যায়। সময় সম্পর্কে তিনি যথেষ্টই চিন্তাভাবনা করেন। টেক্সাসের একটি পাহাড়ে ফাঁপা করে সেখানে চার কোটি ২০ লাখ ডলার খরচ করে ১০ হাজার বছর নির্ভুল সময় দেবে এমন ঘড়ি বসিয়েছেন। এটি “দীর্ঘ সময় নিয়ে তার চিন্তাভাবনার” কথাই বলে।

এবং সত্যি করে বলতে গেলে, বেজোস সবসময়ই দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা মাথায় রেখে ব্যবসাকে দেখেছেন।





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar