ad720-90

মুঠো মুঠো আয়


মুঠোফোন মানেই খরচের প্রশস্ত এক রাস্তা। কিন্তু এই মুঠোফোন থেকেই আয় করা যায়। এটাই হতে পারে আপনার জীবিকা বা বাড়তি আয়ের উৎস। এ জন্য চাই একটু উদ্যোগ, একটু চেষ্টা আর বুদ্ধি খাটানো।

মোবাইল ফোন মানেই তো খরচ। সংযোগ না হয় মাঝেমধ্যে বিনা মূল্যে পাওয়া যায়, কিন্তু সেটের দাম, কথা বলা, এসএমএস, ইন্টারনেটের এমবি, জিবি—একটার পর একটা খরচ চলতেই থাকে, তা যে প্যাকেজই কিনুন না কেন। আর স্মার্টফোন হলে তো খরচ আরও বেড়ে যায়। মুঠোফোন সময় নষ্ট করছে যেমন, তেমনই পয়সাও খরচ করছে। পড়ার অভ্যাসটাও ভেসে গেছে মোবাইল ফোন স্মার্ট হওয়ার পর।

ওপরের সব কথাই নেতিবাচক। মুঠোফোন নিয়ে নেগেটিভ কথাই বেশি হয়। তারপরও ১৭ কোটি মানুষের দেশে ১২ কোটি মানুষই মুঠোফোন ব্যবহার করে। কেন? যোগাযোগ। হ্যাঁ, অনেক নেগেটিভের মধ্যে শুধু একটা পজিটিভের কথা বললেই মুঠোয় থাকা এই যন্ত্রের মাহাত্ম্য বোঝা যায়। মানুষ মানুষের সঙ্গ চায়। ছোঁয়ায় থাকতে চায়। এই যুগে এই ব্যস্ত যান্ত্রিক জীবনে সরাসরি গিয়ে কথা বলা, যোগাযোগ রাখা বেশ কঠিনই। এই যন্ত্র দিয়ে গলার স্বর তো শোনা যায়, যোগাযোগটা তো হয়। সেই যোগাযোগে নগদ নারায়ণযোগও ঘটতে পারে, যদি ঘটে কিছু বুদ্ধি থাকে।
একটা ঘটনা শোনাই। গত ফেব্রুয়ারিতে বান্দরবানের থানচি ও মদকে গিয়েছিলাম। আগের রাতে ছিলাম আলীকদম উপজেলায়। সেখানে শুনলাম মদকে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। আর থানচিতে রবি ছাড়া অন্য কোনো মোবাইল সংযোগ কাজ করে না। আমার গ্রামীণ, ছেলের বাংলালিংক। আলীকদমে রবির সিম পাওয়া যাবে? যাবে।
গেলাম আলীকদম বাজারে। সিম কার্ড বিক্রেতা বললেন, সংযোগ নিতে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি আর এক কপি পাসপোর্ট আকারের ছবি লাগবে। পরিচয়পত্র আছে, কিন্তু ওয়ালেট হাতড়ে ছবি আর পেলাম না। দোকানি বললেন, ‘সামনের রাস্তায় কয়েক কদম হাঁটলেই ছবি তোলার স্টুডিও পাবেন।’ গেলাম স্টুডিওতে। সাধারণ দোকান। ফটোকপিয়ার আছে, কম্পিউটার আছে, প্রিন্টার আছে, মুঠোফোনও আছে। কিন্তু স্টুডিও সেটআপ নেই। স্টুডিওর কর্মীদের জানালাম, ছবি তুলতে চাই। তাঁরা জানালেন, হবে।
একটা টুলে বসানো হলো। মাথার ওপরে অ্যানার্জি বাতি, মুখের সামনে ধরা হলো চার্জার লাইট। পেছনে নীল কাপড়। মোটামুটি সব রেডি। কিন্তু ক্যামেরা? একটা সাধারণ মানের স্মার্টফোন ধরে গম্ভীর মুখে স্টুডিওকর্মী আমাকে নির্দেশনা দিতে থাকলেন—মাথা একটু নামান, একটু ডানে…। মনের মধ্যে সংশয়, কি-না-কি ছবি তোলেন তাঁরা। এভাবেই ছবি তোলা হলো। স্মার্টফোন থেকে ছবি নেওয়া হলো কম্পিউটারে, এরপর ফটোশপে চলল সম্পাদনা। তারপর প্রিন্টারে নির্দেশ…ছবি বের হয়ে এল।
পার্বত্য অঞ্চলের এই দোকানটায় মুঠোফোন মূল্য সংযোজন বা ভ্যালু অ্যাড করেছে। অন্য কাজের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরেকটি কাজ। তা আমার মতো আগন্তুকের জরুরি প্রয়োজন যেমন মেটাল, তেমনি দোকানির বাড়তি আয়ও করে দিল। মুঠোফোন শুধু খরচই বাড়ায় না, আয়ও করে। কখনো টুকটাক আবার কখনো মুঠো মুঠো আয়ও হতে পারে।

হাতের মুঠোয় বুটিক
ধরুন তাহমিনা খানের কথা। নিজের ডাকনাম ‘শৈলী’ নামে তাঁর নিজের একটা বুটিক হাউস রয়েছে ঢাকার লালমাটিয়ায়। গয়না, পোশাক ইত্যাদি বিক্রি হয় সেখানে। মূল বিকিকিনিটা এখনো চলে ফেসবুকের মাধ্যমে। ঘরে গয়না বানাতেন, আচার বানাতেন—সেগুলোর ছবি তুলে নিজের ফেসবুকে দিতেন, দামটাও লিখে দিতেন। পণ্য পৌঁছে দেওয়ার খরচটাও উল্লেখ থাকত সেখানে। ফেসবুকটাও চালাতেন স্মার্টফোনে। সেই ছবি দেখে ফেসবুকে থাকা তাঁর বন্ধুরা পণ্যের চাহিদা জানাতেন আর তাহমিনা খান তা পাঠিয়ে দিতেন। টাকার লেনদেন হতো পণ্য পৌঁছানোর পর। এভাবেই শুরু। এরপর ফেসবুক পেজ ‘ফ্রেন্ডস অব শৈলী’, তারপর বুটিক হাউস ‘শৈলী’।
ডিজাইনার মনিদীপা দাশগুপ্তার বেলায়ও এই মুঠোফোন। নিজের ডিজাইন করা পোশাকের ছবি মুঠোফোনে তুলে ফেসবুকে দেন। বন্ধুদের শেয়ার করতে অনুরোধ করেন। এভাবে বিক্রি হয়ে যেতে থাকে তাঁর ডিজাইন করা পোশাক।
শুধু কি পোশাক, গয়না? চাইলে খেতের কলাটা-মুলাটা, এলাকার প্রসিদ্ধ খাবারের ছবি তুলে, তথ্য দিয়ে বেচাকেনা শুরু করতে পারে যে কেউ।

ই-কমার্স এজেন্ট
নানা ধরনের ইলেকট্রনিক বাণিজ্যের উদ্যোগ এ সময়টাতে চোখে পড়ে। কিছু আছে সারা দেশ থেকে শস্য, হস্তশিল্প ইত্যাদি সংগ্রহ করে কোনো কোনো ওয়েবসাইট সেগুলো বিক্রি করে। তেমনই একটি উদ্যোগ ‘আমার দেশ আমার গ্রাম’। আপনার যদি একটি স্মার্টফোন থাকে, তবে আপনিও যুক্ত হতে পারেন এই উদ্যোগে। আপনার গ্রামের নারীরা হয়তো খুব সুন্দর নকশিকাঁথা বোনেন, কিংবা কুমারপাড়ায় তৈরি হয় মাটির দারুণ সব জিনিস। সেগুলোর ছবি তুলে আমার দেশ আমার গ্রামে পাঠিয়ে দিন, আপনি হয়ে যাবেন তাদের ই-কমার্স এজেন্ট। পণ্য বিক্রি হলে কমিশন পাবেন, বিক্রি না হলেও একটা ফি পাবেন। এ ধরনের সুযোগ অনেক ই-কমার্স সাইটেই পাওয়া যায়।

মোবাইল ব্যাংকিং এবং…
বিকাশ, রকেটে করে টাকা পাঠানো এখন দ্রুত ও সহজ। মুঠোফোন থাকলে এই মোবাইল ব্যাংকিং সেবাও হতে পারে আপনার আয়ের উৎস। এ জন্য অবশ্য হাট-বাজার, গঞ্জ, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড কিংবা মানুষজন বেশি আসে এমন জায়গায় ছোট্ট একটা দোকানের প্রয়োজন হবে। বিকাশ, রকেট, জিপে, শিওর ক্যাশ নামে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এখন চলছে। প্রথমে এগুলোর এজেন্ট অ্যাকাউন্ট খুলে নিতে হবে। প্রতি ১ হাজার টাকায় ৫ টাকা করে কমিশন। শুনতে কম মনে হলেও লেনদেন যখন বেশি হয়, তখন লাভটা কম হয় না। ঢাকার কারওয়ান বাজারের একটা ফটোকপিয়ারের দোকানের সামনে একটা টেবিল আর টুল নিয়ে বসে থাকেন মো. সবুজ। টেবিলের ওপর রকেটের পোস্টার, পাশে বিকাশ। তিনি ফ্লেক্সিলোডের কাজও করেন। মানে মুঠোফোনে টাকা ভরে দেন। এ ক্ষেত্রে প্রায় সংযোগেই প্রতি হাজারে সাড়ে ২৭ টাকা কমিশন পান। সবুজ বললেন, ‘লেনদেন বেশি হলে লাভ বেশি। লাভ বেশি হলে দোকানও দেওয়া যায়।’ আবার কারও মুদি বা স্টেশনারি দোকানে বাড়তি আয়ের জন্য মোবাইল লেনদেনের এই সেবাটা দেওয়া যায়।

আরও সুযোগ
মুঠোফোন, কম্পিউটার আর প্রিন্টারের সমন্বয়ে ছোটখাটো ব্যবসা তো গড়ে তোলাই যায়ই, সে রকম উদাহরণও অনেক। যদি কারিগরি দিকে আগ্রহ থাকে, তবে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুঠোফোনের সারাইখানা দিতে পারেন। দেশে মুঠোফোনের প্রসার যত বাড়বে, তত মেরামতের ব্যবসা জমবে।
এই মুঠোফোন দিয়েই নিউইয়র্ক বা টোকিওর পুঁজিবাজারে শেয়ার কেনাবেচা করতে পারেন। এখন অনেক অ্যাপ রয়েছে, যেগুলো শেয়ারবাজারের লেনদেন শিখিয়ে দেবে আপনাকে। মুঠোফোনেই লেনদেন, কেনাবেচা করা যাবে। তবে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: অভিজ্ঞ মানুষের পরামর্শ ছাড়া, জানা-বোঝা ছাড়া আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে না নামাই উচিত।

মোদ্দা কথা
যতই বলা হোক, মুঠোফোন খরুচে, কিন্তু এটা যে দারুণ কাজের, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মুঠোফোনই হয়ে উঠতে পারে আপনার জীবিকার উৎস, আয় বাড়ানোর মোক্ষম অস্ত্র। শুধু যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে, নিজের বুদ্ধি খাটাতে হবে আর কাজে নেমে পড়তে হবে।





সর্বপ্রথম প্রকাশিত

Sharing is caring!

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar